ফরিদপুরের বোয়ালমারীতে রবিউল ইসলাম নামে এক যুবক গত দেড় যুগেরও অধিক সময় ধরে শিকলে বন্দি। মাত্র দশ বছর বয়সে মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে আঠারো বছর যাবত অস্বাভাবিক জীবনযাপন করছে।
শুক্রবার (৩০ জুলাই) সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, রবিউল ইসলাম বাড়ির একটি ভাঙ্গা ঘরের ভেতর এক ছোট গর্তে শুয়ে আছে। কোমরে লোহার শিকল বাঁধা। মুখে ঘন দাড়িভর্তি। পরনে কোন কাপড় নেই।
তিন ভাইয়ের মধ্যে বড় রবিউল ফরিদপুর জেলার বোয়ালমারী উপজেলার ময়না ইউনিয়নের বর্নিরচর পশ্চিমপাড়া গ্রামের নুরুল ইসলামের বড় ছেলে।
হতভাগা বাবা নুরুল ইসলাম পেশায় একজন কৃষক। আর্থিক অবস্থা নাজুক হওয়ায় পরিবারের একটু স্বচ্ছলতার জন্য মাঝে মাঝে ভ্যান চালিয়ে বাড়তি উপার্জনের চেষ্টা করেন। ছেলের মানসিক ভারসাম্যহীন অবস্থা তাকে প্রচন্ডভাবে ব্যথিত করলেও তিনি নিরূপায়। পৈতৃক সূত্রে প্রাপ্ত সামান্য জমিজমা আর নিজের অর্জিত উদ্বৃত্ত অর্থের সবটাই ছেলে রবিউলকে সুস্থ করতে তার চিকিৎসার পেছনে ব্যয় করেছেন। চিকিৎসক, কবিরাজ, ফকির সবই দেখিয়েছেন। কিন্তু কোন সদর্থক ফলাফল অর্জিত হয়নি।
রবিউলের বাবা নুরুল ইসলাম বলেন, রবিউল দশ বছর পর্যন্ত সুস্থ স্বাভাবিক ছিল। হেসে-খেলে বেড়াত। তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময় হঠাৎ করে তার মধ্যে মানসিক ভারসাম্যহীন অবস্থা দেখতে পাই। এরপর নিজের সাধ্যমতো চিকিৎসার চেষ্টা করেও সুস্থ করতে পারিনি।
রবিউলের ছোট ভাই ইনামুল হোসেন বলেন, বর্তমানে ভাই যে ঘরে থাকে এখানে আমাদের মুদি দোকানঘর ছিল। দীর্ঘ প্রায় ১৮ বছর এই ঘরেই আমার ভাইটা এইভাবে পড়ে আছে। মাজায় ও পায়ে শিকল দিয়ে বাঁধা। সারাদিন শুধু হাত দিয়ে মাটি খুঁড়ে। হাঁটতে পারে না, কথা বলতে পারে না। শরীরে কোনো কাপড়-চোপড় রাখে না।
সরেজমিনে শুক্রবার এই তরুণের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল মনভাঙা এক দৃশ্য। বাড়ির পরিত্যক্ত চৌচালা একটি টিনের ঘরে মাজায় তালাসহ শেকল লাগানো রবিউলকে পাওয়া গেলো প্রায় ছয় ফুট গভীর মাটির গর্তে। এখানেই আলো-বাতাস ছাড়া দিন-রাত কাটে তার।
পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, গত ১৫ বছরের শেকলবন্দি জীবনে ঘরটির মাটির মেঝে হাত দিয়ে খুঁড়ে খুঁড়ে রবিউল নিজেই তৈরি করে নিয়েছেন নিজের এই পৃথিবী। অর্থ্যাৎ চার দিকে প্রায় ১১ ফুট ব্যাসের ও ছয় ফুট গভীর গোলাকার মাটির এই গর্ত। রবিউলের হাতের নখ ও আঙুল ব্যবহার করে তৈরি বড়সড় গর্তটি যেন একটি বাংকারেই রূপ নিয়েছে। পরিবারের বসবাসে পরিত্যক্ত এই টিনের ঘর প্রায় ২৬ হাত লম্বা ও আট হাত চওড়া।
রবিউলের মা আসমানী বেগম বলেন, রবিউলের সাত-আট বছর বয়সে জ্বর হয়েছিল। অসুস্থতার পর আস্তে আস্তে তার হাত-পা শুকিয়ে যেতে থাকে। পরিবারের সাধ্যমতো ডাক্তার-কবিরাজ সব দেখানো হলেও আর সুস্থ স্বাভাবিক হয়নি সে। এখন শীত-গরম কোনো অনুভূতিই তার শরীরে নেই। তাই শরীরে কখনোই কোনো কাপড় রাখে না রবিউল।
রবিউলকে দেখতে আসা লোকজন জানালেন, রবিউলের পরিবারের এই অসহায় অবস্থা দেখে ভালো লাগে না। সমাজের কেউ একটু এগিয়ে আসে না তাদের পাশে। তারা মনে করেন সরকারিভাবে উদ্যোগ নিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করলে হয়তো রবিউলও অন্যদের মতো জীবন-যাপন করতে পারবেন।
এ ব্যাপারে ময়না ইউনিয়নের বাসিন্দা শিক্ষক মুকুল কুমার বোস বলেন, যথাযথ চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে পারলে রবিউলকে হয়তো সুস্থ করা যেত। কারণ রবিউলের পিতা দরিদ্র হওয়ায় উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে পারেননি। কোন আর্থিক সামর্থ্যবান লোক রবিউলের চিকিৎসায় এগিয়ে এলে হয়তো ছেলেটি আবার সুস্থ, সুন্দর, স্বাভাবিক জীবন ফিরে পেত।
এ ব্যাপারে ময়না ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নাসির মো. সেলিম বলেন, ‘ছেলেটি মানসিক ভারসাম্যহীন। শিকল খুলে দিলেই ও অন্যত্র চলে যায়। কাপড়ও পরনে রাখতে চায় না।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমার নিকট ওদের পরিবারের কেউ কখনো সাহায্যের ব্যাপারে আসেনি। এলে আমি নিশ্চয়ই সাহায্য করব।’
বোয়ালমারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ঝোটন চন্দ জানান, ‘বিষয়টি সোস্যাল মিডিয়াতে রবিউলের বিষয়টি আসার পরে আমাদের নজরে এসেছে। আমরা তার পরিবারের খোঁজ-খবর নিয়ে তাকে (রবিউলকে) চিকিৎসার জন্য সহায়তা করা হবে।
মাটির গর্তে বেঁধে রাখার বিষয়ে ইউএনও বলেন, ‘কাজটি ঠিক হয়নি। একজন মানুষের সাথে এমন কাজ করা অন্যায় হয়েছে।’
প্রিন্ট