আলিফ হোসেনঃ
রাজশাহী অঞ্চলে ভূ-গর্ভস্থ পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে।এতে জনজীবন ও কৃষিতে বিরুপ প্রভাব পড়েছে।একদিকে গ্রীষ্মের কারণে তাপপ্রবাহ, অন্যদিকে অস্বাভাবিক হারে নিচে নেমে গেছে ভুগর্ভস্থ পানি। এই দুই-য়ে মিলে ভয়াবহ অবস্থা।
.
স্থানীয় সুত্র জানায়, এই অঞ্চলে ভূ-গর্ভস্থ পানির সংকট সৃষ্টির সিংহভাগ দায় পল্লী বিদ্যুতের।কারণ পল্লী বিদ্যুতের একশ্রেণীর দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশে আবাসিক, শিল্প, মৎস্য চাষের সংযোগ থেকে নির্বিচারে
সেচ পানি উত্তোলন করা হচ্ছে।অথচ উপজেলা সেচ কমিটির অনুমোদিত মটর ব্যতিত,অন্যকোন মটর থেকে সেচ দেয়া যাবে না। যদি সেচ দেয়া হয়, তাহলে সেই মটরের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার কথা।কিন্ত্ত আর্থিক সুবিধার বিনিময়ে পল্লী বিদ্যুৎ সেটা করছে না।
.
এদিকে পানিসম্পদ পরিকল্পনা সংস্থার (ওয়ারণ্যে) রাজশাহী কার্যালয় সুত্রে জানা গেছে, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁ জেলার ৮৬ উপজেলায় পানির স্তর ভয়াবহভাবে নিচে নেমে গেছে। তাদের করা গবেষণার তথ্য মতে, রাজশাহীর বরেন্দ্র অঞ্চলের ৭১ শতাংশ এলাকা মাঝারি, উচ্চ ও অতিউচ্চ পর্যায়ের পানি সংকটাপন্ন। গবেষক ও বিশেষজ্ঞদের ভাষ্য, সাম্প্রতিক সময়ে কম বৃষ্টিপতের পাশাপাশি গত বছর বরেন্দ্র এলাকায় তিনটি কৃষি মৌসুমের পুরো চাষাবাদ হয়েছে ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার করে। পানির স্তর অস্বাভাবিক নিচে নামার পাশাপাশি অবৈধ মটর দিয়ে নির্বিচারে পানি তোলায় এ অঞ্চলে তাপপ্রবাহের সময়সীমা যেমন বেড়েছে, তেমনি কৃষি কাজে ব্যবহার ও খাওয়ার পানির সংকট তৈরি হয়েছে। ওয়ারপোর গবেষণায় বলা হয়, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে কম বৃষ্টিপাত, দীর্ঘস্থায়ী খরা ও ভুগর্ভস্থ পানি উত্তেলনের কারণে পানির স্তর ক্রমশ নিচে নামছেই।
.
গত গ্রীষ্মে রাজশাহীর তানোর উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নি স্তর নিচে নেমেছে ১১৩ ফুট পর্যন্ত। এর পুনর্ভরণ না হওয়ায় গড়ে এ অঞ্চলে ৪ ফুট করে নেমেছে পানির স্তর। সেই সঙ্গে অন্বাভাবিক হারে বাড়ছে তাপমাত্রা। ওয়ারপোর নির্বাহী প্রকৌশলী নিলয় কুমার দাস জানান, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ বরেন্দ্র অঞ্চল ৭১ শতাংশ এলাকা মাঝারি, উচ্চ ও অতিউচ্চ পর্যায়ের পানি সংকটাপন্ন তানোর এলাকায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমেছে ১১৩ ফুট পর্যন্ত ও নওগাঁ জেলায় চার বছর তারা ৫০টি মেশিন স্থাপন করে পানির স্তর নিয়ে গবেষণা করেছেন। তাতে ৮৬ উপজেলার হাল খুবই নাজুক। মোট এলাকার ৭১ ভাগ পানির সংকটে আছে।
.
জানা গেছে, রাজশাহীর তানোর উপজেলার পাঁচন্দর ও বাধাইড় ইউনিয়নে (ইউপি) পানি সংকট সবচেয়ে বেশি। এখানকার বাসিন্দারা প্রায় এক কিলোমিটার দূর থেকে পানি সংগ্রাহ করছেন তাদের গৃহস্থালি কাজে ব্যবহার ও খাওয়ার জন্য। অন্যদিকে রাজশাহীর বাঘা ও নওগাঁর নিয়ামতপুর উপজেলার কয়েকটি গ্রামে একই চিত্র দেখা গেছে। টিউবওয়েল ও ডিপ টিউবওয়েল দিয়ে উঠছে না পানি।
.
এদিকে, রাজশাহীর তানোরের পাঁচন্দর, বাধাইড়, কলমা ইউনিয়ন (ইউপি) ও মুন্ডুমালা পৌরসভার উঁচু এলাকায় পানির অভাবে ও চৈত্রের খরতাপে কৃষি জমি ফেটে চৌচির। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাওয়ায় মিলছে না সেচও। এলাকাবাসী জানায়, খাবার পানি ও ঘর গৃহস্থালির কাজের জন্য পানির সংকট চরমে। ফসলের ফলন নিয়েও শঙ্কার শেষ নেই তাদের। তানোরের সীমান্তবর্তী নওগাঁর মান্দা, নিয়ামতপুর ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল উপজেলায় পানির সংকট দেখা দিয়েছে।
.
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক চৌধুরী সারওয়ার জাহান বলেন, ‘অনাবৃষ্টি, তীব্র তাপপ্রবাহ ও প্রচন্ড খরায় রাজশাহী অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নামছে জ্যামিতিক হারে। এভাবে চলতে থাকলে আগামী ২০-৪০ বছরের মধ্যে এ অঞ্চলে মাটির নিচে পানি পাওয়া যাবে না।’ তিনি বলেন, ভূ-উপরিস্থ পানির ব্যবহার বাড়ানো, পানি কম লাগে এমন ফসল চাষ, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ, বৃষ্টির পানির মাধ্যমে মাটির তলদেশ রিচার্জ করা গেলে এ সংকট মোকাবিলা করা যাবে। এবিষয়ে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) চেয়ারম্যান ড. আসাদুজ্জামান জানান, ইতোমধ্যে তারা কৃষকদের উদ্বুব্ধ করছেন কম পানির ব্যবহার হয় এমন ফসল চাষের।
প্রিন্ট