তীব্র শীত উপেক্ষা করে গুড় তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার আখ চাষিরা। শীত মৌসুম এলেই শুরু হয়ে যায় সুস্বাদু আখের গুড় তৈরির কাজ। একদিকে আখ কেটে সংগ্রহ করা হচ্ছে, অন্যদিকে কেটে আনা আখ থেকে মেশিনের মাধ্যমে রস সংগ্রহ করে সেই রস জাল দিয়ে তৈরি করা হচ্ছে গুড়।
শীত বাড়তেই বাঙালির ঘরে শুরু হয়েছে পিঠা-পুলির মহোৎসব। এসব পিঠায় আখের গুড়ের কদর রয়েছে ব্যাপকহারে। দৌলতপুর উপজেলার দৌলতখালী ও আদাবাড়িয়া ইউনিয়নের আমদহ এলাকায় ও লালনগর গ্রামের মাঠে দেখা যায়, আখের গুড় তৈরিতে ব্যস্ত চাষিরা। বিগত দুই বছর ধরে এই এলাকায় শীত মৌসুমে আখ থেকে গুড় তৈরি করেন তারা। তবে আগের মতো আখচাষ না থাকায় তেমন একটা চোখে পড়ে না রস থেকে গুড় তৈরির দৃশ্য।
আজ বুধবার ১৭ জানুয়ারী ২০২৪ ইং তারিখে সরেজমিন দেখা যায়, গ্রামের নারী-পুরষ, কিশোর-কিশোরীরা আখ থেকে পাতা ও আগা বাদ দিয়ে আলাদা করে রাখছেন। সেই পাতা ও আগার অংশটুকু নিয়ে যাচ্ছেন বাড়িতে গৃহপালিত পশুর খাবার হিসেবে। এরপর রেখে দেওয়া আখ থেকে কারিগররা একটি মেশিনের মাধ্যমে রস বের করছে।
তার পাশেই একটি বিশাল বড় মাপের চুলা তৈরি করে তার ওপর চাপানো হয়েছে বিশাল মাপের লোহার কড়াই।
তাতেই আখের রস ঢেলে জ্বাল দেওয়া হচ্ছে। সেই কড়াইয়ের দিকে সজাগ নজর কারিগরদের। কারিগররা প্রায় ২ থেকে ৩ ঘণ্টা রস জ্বাল দেন। পরে তা চুলা থেকে নামিয়ে ২০ থেকে ২৫ মিনিট রাখার পর শক্ত হয়। পরে কারিগরদের হাতের সাহায্যে শক্ত গুড়গুলোকে একটি নির্দিষ্ট আকার দেওয়া হয়। এভাবেই তৈরি করা হয় আখের রস থেকে সুস্বাদু গুড়।
স্থানীয় আখচাষিরা বলেন, এখানকার গুড় নির্ভেজাল ও খাঁটি হওয়ায় স্থানীয় বাজারে প্রচুর চাহিদা রয়েছে। চাষে খরচ কম ও তুলনা মূলক লাভজনক হওয়ায় আগ্রহ বাড়ছে স্থানীয় কৃষকদের। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এ বছর আখের ফলনও ভালো হয়েছে। তবে কৃষি অফিসের সহযোগিতা পেলে উপজেলায় আখ ও গুড়ের উৎপাদন বাড়বে।
আখের গুড় তৈরির কারিগর মো. ছাপাত আলী বলেন, আমি নাটোরের বনপাড়া এলাকা থেকে কাজ করতে এসেছি। দীর্ঘ ১০ বছর ধরে এই পেশায় আছি। শীত মৌসুমের শুরু থেকেই আমরা মহাজনের সঙ্গে যোগাযোগ করে জেলা-উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় আখের রস থেকে গুড় বানানোর কাজ করি। আখ কাটা থেকে শুরু করে গুড় তৈরি পর্যন্ত প্রায় এক মাস এখানে থাকতে হয়। এরপর আবার অন্য এলাকায় গুড় তৈরির জন্য যাবো। এভাবেই শীতের সময় এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় গিয়ে কাজ করতে হয়।
তিনি বলেন, প্রতিদিন ৩ কড়াই গুড় তৈরি করি। পারিশ্রমিক হিসেবে কড়াই প্রতি ৭০০ শত থেকে ৯০০ শত টাকা করে পাই। এতে করে কোনো রকম ডাল-ভাত খেতে পারি ।
আখচাষি মোজাম্মেল হক বলেন, প্রতি বিঘা জমিতে আখ চাষে খরচ হয় মাত্র ২০ থেকে ২২ হাজার টাকা। উৎপাদন ব্যয় মিটিয়ে প্রতি বিঘা জমি থেকে উৎপাদিত আখের গুড় বিক্রি করে লাভ হয় ৩৫ থেকে ৪০ টাকা। স্থানীয় বাজারে প্রতি কেজি আখের গুড় পাইকারি ১২০ থেকে ১৩০ টাকা কেজি। খুচরা বিক্রি করা যায় ১৬০ থেকে ১৮০ টাকা কেজি। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে দেশের বিভিন্ন জেলায় গুড় সরবরাহ করা হয় দৌলতপুর থেকে। সরকারি প্রণোদনা পেলে আখের গুড় উৎপাদন বাড়াতে পারবেন বলে আশা করেন প্রান্তিক কৃষকরা।
আখ ক্ষেতের মালিক সিরাজুল মোল্লা বলেন, এক মৌসুমের ফসল চাষ করার পর আখ চাষ করি। পরবর্তীতে তা গুড় তৈরির মহাজনদের কাছে বিক্রি করে দিই। পরে তারা শীতের সময় এসে সেই আখ থেকে গুড় তৈরি করে। বিগত বছরগুলো আমাদের জন্য অনেক ভালো ছিল। এ বছর দৌলতপুর বিভিন্ন বাজারে দুই হাজার থেকে আড়াই হাজার টাকা প্রতি মণ গুড় বিক্রি করছি। আশা করছি এ মৌসুমে প্রায় ৩-৪ মণ গুড় উৎপাদন করতে পারবো।
আখ মাড়াই কাজে যারা নিয়োজিত তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আখের রস জ্বাল দেওয়ার পর তা ঘন হয়ে উঠলে টিনের তৈরি ড্রামের মধ্যে সংরক্ষণ করা হয়। উত্তাপ কমে এলে ৮ থেকে ১০ ঘণ্টার মধ্যে গুড় জমাট বাঁধে। এছাড়া আখের রশিও (তরল গুড়) বাজারে বিক্রি হয়। তরল গুড় আলাদা বোতলে সংরক্ষণ করা হয় বাজারজাতের উদ্দেশ্যে।
আখের মান ভালো হলে প্রতি খোলা (গুড় জ্বাল দেওয়ার কড়াই) থেকে ৪০-৫০ কেজির মতো গুড় পাওয়া যায়। প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চার-পাঁচটি গুড়ের খোলা ওঠানো সম্ভব হয়।
দৌলতপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোঃ নুরুল ইসলাম জানান, চলতি মৌসুমে দৌলতপুর উপজেলায় ৮ হেক্টর জমিতে আখের চাষ হয়েছে। আখচাষিদের জন্য সরকারি কোনো প্রকার বরাদ্দ না থাকায় আমরা তাদের শুধু পরামর্শ দিয়ে থাকি।
প্রিন্ট