আলিফ হোসেনঃ
রাজশাহীর আলু চাষিরা পুঁজি হারানোর শঙ্কায় দিশেহারা।আলুর কম মূল্যে মাথায় হাত কৃষকের। এখনো হিমাগারে মজুত প্রায় ৬০ ভাগ আলু।তবে রপ্তানি করা সম্ভব হলে চাষিরা উপকৃত হতেন। জানা গেছে, রাজশাহীর বিভিন্ন এলাকায় আলু আহরণের সময়ে অস্বাভাবিক দরপতন ঘটেছিল। যে কারণে চাষিরা বর্ষা মওসুমে (অফ সিজন) বেশি দাম পাওয়ার আশায় বেশি ভাড়ায় হিমাগারে আলু সংরক্ষণ করেন। কিন্তু অফ সিজিনেও আলুর কাঙ্ক্ষিত দাম না পাওয়ায় বিপুল লোকসানের মুখে পড়েছেন হাজার হাজার আলু চাষি।একদিকে হিমাগার ভাড়া বেশী,অন্যদিকে বাজারে দাম কম একই সঙ্গে হিমাগারে আলুর পচন,সব মিলিয়ে আলু পাকে পড়ে আলু চাষিরা নিঃস্ব হবার পথে।
রাজশাহীর বিভিন্ন এলাকার হাট-বাজারে বর্তমানে খুচরা আলুর কেজি ২০-২৫ টাকা। হিমাগার ফটকে ১৫ টাকা কেজিতে আলু বিক্রি হচ্ছে। এই অস্বাভাবিক দরপতনের কারণে ছোট চাষি ও মৌসুমী ব্যবসায়ীরা হিমাগার থেকে আলু বের করছেন না। রাজশাহীর অনেক হিমাগারে আলুতে পচন ধরেছে।বিশেষ করে তানোরের মেসার্স তামান্না হিমাগারে আলুর অবস্থা ভয়াবহ। প্রতি বস্তার বেশিরভাগ আলুতে গাছ গজিয়েছে।এতে অনেক চাষি বাধ্য হয়ে হিমাগার থেকে আলু বের করে পানির দামে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। অনেকেই পুঁজি হারানোর শঙ্কায় আছেন,কেউ পুজি হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছেন।
এদিকে ভুক্তভোগী চাষিরা বলছেন, এবার সাধারণ ও বাণিজ্যিক চাষিরা আলু চাষ করে বিপুল লোকসানের কবলে পড়েছেন। গত মওসুমে উৎপাদন বেশি হওয়ায় ও বাজারে চাহিদা না থাকায় আলুর ভরা মওসুমে জমিতে বিক্রি হয়েছে ১২ থেকে ১৫ টাকা কেজি। চাষি ও মৌসুমী ব্যবসায়ীরা বর্ষা মওসুমে দাম বাড়ার আশায় বেশি ভাড়ায় হিমাগারে সংরক্ষণ করেছিলেন লাখ লাখ টন আলু। কিন্তু বর্তমানে আলুর দামে হতাশ তারা।
চাষিরা আরও বলছেন, বীজ আলু ছাড়া খাবার আলু আর বেশি দিন হিমাগারে রাখা যাবে না। হিমাগারের সঙ্গে তাদের নির্ধারিত সময়ের চুক্তি রয়েছে। সময় শেষ হলে হিমাগার মালিকেরা একদিনও আলু রাখবে না।
ইতোমধ্যে বিভিন্ন এলাকার হিমাগার মালিকেরা আলু বের করার জন্য নোটিশ দেওয়া শুরু করেছেন। ভুক্তভোগী চাষিরা বলছেন, এখন বাজারে আলুর দাম নেই, দেশের অন্য কোথাও চাহিদাও নেই। এখন এই সময়ে সংরক্ষিত বিপুল পরিমাণ আলু কোথায় নিয়ে যাবেন তারা।
রাজশাহীর উপজেলার পাঁচন্দর ইউনিয়নের (ইউপি) মোহাম্মদপুর গ্রামের কৃষক রায়হান আলী (৬০) বলেন, তিনি পেইড বুকিং দিয়ে আলু রেখেছেন। যাহার বুকিং নম্বর ১৫০৫, লট নম্বর, ৮৫৩২,পরিমাণ ৯৮ বস্তা। একই গ্রামের কৃষক তারেক বুকিং নম্বর ১৫০৫, লট নম্বর ৮৫৩৩, পরিমাণ ৩০ বস্তা, লট নম্বর ৮৫৩৪ পরিমাণ ১২ বস্তা, লট নম্বর
৮৫৩৫ পরিমাণ ৬ বস্তা ও লট নম্বর ৮৫৩৬ পরিমাণ ৩৯ বস্তা।কিন্ত্ত পেইড বুকিং কাটার পরেও তাদের আলু পিসিতে রাখা হয়েছে যেকারনে প্রায় অর্ধেক আলু নষ্ট ও বাঁকি আলুতে গাছ গজিয়েছে। কৃষক রায়হান আলী বলেন, ১১ জুলাই শুক্রবার স্টোরে এসে জানতে পারেন তার আলু পিসিতে রাখা হয়েছে। তিনি ৮৯ বস্তা আলু বের করে সেডে বাছাই করে মাত্র ৬১ বস্তা আলু পেয়েছেন,এসব আলুতেও গাছ গজিয়েছে বলতে গেলে তার পুরো আলু নষ্ট।
অথচ স্টোর বস্তাসহ ৭০ কেজি আলুর ভাড়া নিয়েছেন। তিনি বলেন,শুধু তিনি না তার মতো অসংখ্য কৃষকের আলুতে গাছ গজিয়ে নষ্ট হয়েছে। আলু যদি নষ্টই হবে তাহলে এতো টাকা খরচ ও ঝক্কি-ঝামেলা সহ্য করে স্টোরো আলু রাখার প্রয়োজন কি?
রাজশাহীতে এখন হিমাগার পর্যায়ে প্রতি কেজি আলু বিক্রি হচ্ছে ১৪ টাকায়। হিসাব করে দেখা গেছে, কেজিপ্রতি ৬ টাকা হিমাগারভাড়া, শ্রমিক খরচ, নষ্ট আলু ও কাঁই (ছোট) আলুর সঙ্গে দাম সমন্বয় করে চাষিদের পকেটে ঢুকছে মাত্র ৪ টাকা ৬ পয়সা। এবার এক কেজি আলুর উৎপাদন খরচ পড়েছে ২২ থেকে ২৫ টাকা কেজি। হিমাগারের বাইরে রাজশাহীর বাজার পর্যায়ে এখন খুচরায় প্রতি কেজি আলু ২০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।
অথচ গত সপ্তাহে হিমাগার পর্যায়ে আলুর দাম বেড়ে ১৫ টাকা হয়েছিল। তখন খুচরা বাজারে সেই আলু ২৫ টাকা কেজি বিক্রি হয়। এক সপ্তাহের ব্যবধানে আলুর দরের এই পতন ঘটেছে। অন্যদিকে গত বছর এ সময়ে আলুর দাম ছিল কেজি প্রতি ৬০ থেকে ৮০ টাকা। বেশি দামের আশায় এবার রাজশাহীতে আলুর চাষ বেশি হয়েছে।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, এবার জেলায় ৩৮ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে আলু চাষের লক্ষ্যমাত্রা ছিল। বাস্তবে আরও সাড়ে তিন হাজার হেক্টরের বেশি জমিতে আলু চাষ করা হয়েছে। উৎপাদিত হয়েছে ১০ লাখ ৩০ হাজার ৫০০ টন। গত বছর আলু উৎপাদিত হয়েছিল ৯ লাখ ৪০ হাজার টন।
রাজশাহীর তানোর উপজেলার চোরখৈর গ্রামের আলু চাষি জুয়েল রানা এবার ৩৪ বিঘা জমিতে আলু চাষ করেছিলেন। গত শুক্রবার তিনি ৩৫৯ বস্তা (৬৫ কেজি করে) আলু বিক্রি করেছেন। এর মধ্যে ৩২৫ বস্তা ভালো আলু পেয়েছেন। ১৪ টাকা কেজি হিসাবে দাম পেয়েছেন ২ লাখ ৯৫ হাজার ৭৫০ টাকা। এর মধ্যে ৬ টাকা কেজি প্রতি হিমাগার ভাড়া ও শ্রমিক খরচ বাবদ গেছে ২ লাখ ৫ হাজার টাকা। অবশিষ্ট থাকে ৯০ হাজার ৭৫০ টাকা। এর সঙ্গে ১০০ টাকা বস্তা হিসেবে ২৯ বস্তা নষ্ট আলু থেকে পেয়েছেন ২ হাজার ৯০০ টাকা, ২৬০ টাকা বস্তা হিসাবে পাঁচ বস্তা কাঁই (ছোট) আলু বিক্রি করে পেয়েছেন ১ হাজার ৩০০ টাকা। নষ্ট ও ছোট আলু থেকে মোট পেয়েছেন ৪ হাজার ২০০ টাকা। এটা যোগ করলে তাঁর মোট টাকার অঙ্ক দাঁড়ায় ৯৪ হাজার ৯৫০ টাকা। হিমাগারে রাখা ৩৫৯ বস্তা মানে ২৩ হাজার ৩৩৫ কেজি আলু বিক্রি করে জুয়েল রানা হাতে পাবেন ৯৪ হাজার ৯৫০ টাকা। অর্থাৎ তাঁর প্রতি কেজি আলুর দাম পড়ছে ৪ টাকা ৬ পয়সা। অবশ্য তিনি এই আলু মাঠে বিক্রি করলেই ১৪ টাকা কেজি হিসাবে দাম পেতেন। এখন যে টাকায় বিক্রি করলেন, সেই টাকাও এখনো পাননি। বাকিতে বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন।
কৃষি বিপণন অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, এবার প্রতি কেজি আলুর উৎপাদন খরচ পড়েছে ২২ থেকে ২৫ টাকা। জুয়েল রানা বলেন, এবার নষ্ট আলুর পরিমাণও বেশি। আলুর গায়ে একটি দাগ থাকলেই সেটি নষ্ট হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে। হিমাগারের মালিক এক কেজি আলু থেকে শ্রমিক খরচসহ পাচ্ছেন প্রায় সাত-আট টাকা। আর চাষির পকেটে আসছে চার টাকা। এর চেয়ে পরিহাসের বিষয় আর কী হতে পারে! তিনি বলেন, ঢাকার বাজারে এক কেজি আলু প্রায় ৩০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। এমন একটি সিন্ডিকেট তৈরি হয়েছে যে তারা হিমাগার থেকে বের করে ১৪ টাকা কেজির বেশি দরে আলু বিক্রি করার গ্রাহক পাচ্ছেন না।
রাজশাহীর বিভিন্ন হাটবাজারে খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, খুচরা পর্যায়ে প্রতি কেজি আলু ২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। রাজশাহীর খুচরা ব্যবসায়ীরা শহরের আশপাশের হিমাগার থেকে বের করা আলু ১৬ টাকা কেজি দরে কিনছেন। গাড়ি ভাড়া ও মুনাফা যোগ করে তারা ২০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করছেন। পবার সরকার কোল্ড স্টোরেজের ব্যবসায়ী হামিদুল ইসলামের সঙ্গে কথা হয়। তিনি তিন হাজার বস্তা আলু ১৪ থেকে ১৮ টাকা কেজি দরে কিনে হিমাগারে রেখেছেন। তিনি বলেন, তাঁদের কেজি প্রতি ৬ টাকা হিমাগার ভাড়া, একটি বস্তা ৮২ টাকা ও গাড়িভাড়া ৫০ টাকা বাদ দিয়ে এখন সেই আলু ১৪ টাকা কেজি দরে বিক্রি করতে হচ্ছে।
লোকসানের ভয়ে তাঁরা হিমাগার থেকে আলু বের করছেন না। এতে অনেক হিমাগারে আলু পচতে শুরু করেছে। বাধ্য হয়ে কেউ কেউ পানির দরে আলু বিক্রি করে দিচ্ছেন শুধু হিমাগার খালি করার জন্য। পবা উপজেলার কৃষক নাসিম উদ্দিন বলেন, ‘আমি এই বছর তিন বিঘা জমিতে আলু চাষ করেছিলাম। জমিতেই তো লস (লোকসান) হইছিল। ভাবছিলাম, কয়টা মাস হিমাগারে রাখলে হয়তো দামটা বাড়বে। তিন বিঘা জমিতে ২ লাখ টাকা ব্যয় করে আলু চাষ করে উল্টো লোকসানে সেই আলু বেচতে হচ্ছে। সার, বীজ আর হিমাগারের ভাড়ার টাকা মিলিয়ে যা খরচ হয়েছে, তাতে পথে বসার জোগাড়। এই আলু এখন না বেচলে পচে যাবে, আবার বেচলে শুধু ঋণের বোঝা বাড়বে। আমরা এখন কী করব, কিছুই বুঝতেছি না।’
তানোর উপজেলার একজন মৌসুমি আলু ব্যবসায়ী মোকলেস বলেন, ‘গত বছর যাঁরা আলু মজুত করেছিলেন, তাঁরা ভালো লাভ করেছিলেন। সেই আশায় ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে আর নিজের জমানো টাকা দিয়ে প্রায় দেড় হাজার বস্তা আলু কিনেছিলাম হিমাগারে রাখার জন্য। ভেবেছিলাম, বর্ষায় দাম বাড়লে বিক্রি করে দেব। এখন বাজারদর যা, তাতে হিমাগার থেকে আলু বের করার সাহসই পাচ্ছি না। এই লোকসান কীভাবে সামলাব, ভেবে কূলকিনারা পাচ্ছি না। আমাদের মতো ছোট ব্যবসায়ীরা এবার পথে বসে গেছেন।’
এদিকে চুক্তির সময়সীমা শেষ হয়ে আসায় হিমাগার মালিকেরা আলু বের করে নেওয়ার জন্য নোটিশ দিতে শুরু করেছেন। এতে কৃষকদের সংকট আরও ঘনীভূত হয়েছে।চাহিদার চেয়ে উৎপাদন বেশি হওয়ায় দাম কম। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত মৌসুমে রাজশাহী অঞ্চলে আলুর উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যায়।
চাহিদার চেয়ে জোগান বেশি হওয়ায় মৌসুমের শুরু থেকেই দাম ছিল কম। রাজশাহী অঞ্চলের হিমাগারগুলোতে এখনো প্রায় ২৫ লাখ টন আলু মজুত আছে, যার মধ্যে ২০ লাখ টনই খাবার আলু।এ দরপতনের কারণ হিসেবে কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের জ্যেষ্ঠ বিপণন কর্মকর্তা মো. সানোয়ার হোসেন বলেন, ‘চাহিদার তুলনায় উৎপাদন অনেক বেশি হওয়ায় দাম কমেছে। আমাদের দেশে উৎপাদিত আলুর মান ভালো না হওয়ায় রপ্তানিও সম্ভব হচ্ছে না। রপ্তানি করা গেলে চাষিরা উপকৃত হতেন।’
রাজশাহী হিমাগার মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ফজলুর রহমান বলেন, রাজশাহী অঞ্চলের ৩৭টি হিমাগারে এখনো ৭০ শতাংশ আলু রয়ে গেছে। তিনি বলেন, চাষিরা বিপুলভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এ অবস্থায় সরকারের উচিত ছিল আলুর ন্যূনতম একটি দাম নির্ধারণ করে দেওয়া, যাতে চাষিরা একেবারে নিঃস্ব হয়ে না যান। আলুর দামের যে অবস্থা, তাতে আগামীতে কৃষকেরা আলু চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলতে পারেন, যা ভবিষ্যতে নতুন সংকট তৈরি করবে।
প্রিন্ট