ঢাকা , রবিবার, ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম
প্রতিনিধি নিয়োগ
দৈনিক সময়ের প্রত্যাশা পত্রিকার জন্য সারা দেশে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে প্রতিনিধি নিয়োগ করা হচ্ছে। আপনি আপনার এলাকায় সাংবাদিকতা পেশায় আগ্রহী হলে যোগাযোগ করুন।

ঠাকুরগাঁওয়ের মাটির কুঁড়েঘর থেকেই উঠে আসা তিন নারী ফুটবলার

মাটির কুঁড়েঘর থেকেই জ্বলন্ত পিদিমের মতো আলো ছড়িয়েছেন ঠাকুরগাঁওয়ের প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে উঠে আসা তিন নারী ফুটবলার। সেই আলো বাংলাদেশের গণ্ডি পেরিয়ে আলোকিত করেছে সারা বিশ্ব। তবে, বাতির নিচের অন্ধকারের গল্পের মতোই তাদের জীবনের বাস্তবতা। ফুটবল খেলে দেশের নারী ফুটবলের ভাগ্য পরিবর্তন করলেও পরিবর্তন করতে পারেননি নিজ পরিবারের ভাগ্য। এখনো প্রত্যন্ত অজপাড়া গ্রামের মাটির জীর্ণ ঝুপড়ি ঘরেই বসবাস করছে স্বপ্না রাণী, কোহাতি কাসকো ও সাগরিকাদের পরিবার।

 

অত্যন্ত গরিব পরিবারে বেড়ে উঠা স্বপ্না রাণী ২০১৯ সালে অনূর্ধ্ব-১৭ বয়সভিত্তিক দলে প্রথম সুযোগ পান। এরপর ভারতের ঝাড়খন্ড রাজ্যের জামশেদপুরে গত মার্চ মাসে সাফ অনূর্ধ্ব-১৮ টুর্নামেন্টে অসাধারণ পারফরম্যান্স করেন তিনি। ২০২২ ও ২০২৪ সাফ নারী চ্যাম্পিয়ন দলে খেলেছেন। দেশের জন্যে মুকুট জয়ে পালন করেছেন গুরু দায়িত্ব। অপর দুই জন কোপাতি ও সাগরিকাও ২০২৪ সাফ নারী চ্যাম্পিয়ান দলের গর্বিত সদস্য।

 

এই তিন জনেরই বেড়ে ওঠা ঠাকুরগাঁওয়ের রাণীশংকৈল উপজেলার অজপাড়াগাঁয়ে। পাশাপাশি গ্রামের তিন জনই উঠে এসেছেন রাঙ্গাটুঙ্গী গ্রামে গড়ে ওঠা একটি ফুটবল একাডেমি থেকে।

 

স্বপ্না রাণীর বাড়ি শিয়ালডাঙ্গি গ্রামে। এখানে দুটি মাটির ঘরে বসবাস করে তার পরিবার। স্বপ্নার শোবার ঘরে দুইটি চৌকি, একটি টিনের বাক্স ও ছোট একটি কাঠের শোকেজ রয়েছে। বিভিন্ন সময়ে ফুটবল খেলে পাওয়া পুরস্কার রাখার যায়গা নেই ঘরটিতে। তাই স্বপ্নার সব পুরস্কার বস্তায় ভরে টিনের বাক্সতে রেখে দিয়েছেন পরিবারের সদস্যরা। স্বপ্নার বড় বোন কৃষ্ণা রানী স্থানীয় একটি দরজির দোকানের কাজ করেন। তার আয় করা টাকাতেই চলে সংসারের খরচ।

 

স্বপ্না রাণীর বাবা নিরেন চন্দ্র বলেন,আমার মেয়ে অনেক কষ্ট করে আজ এই পর্যন্ত পৌঁছেছে। এলাকার তাইজুল স্যার জোর করে খেলতে নিয়ে গিয়ে তাকে এতবড় অর্জন এনে দিয়েছেন। বাসায় ডিসের লাইন না থাকায় মেয়ের খেলা দেখতে পারিনি। প্রতিবেশীরা আমাকে জানিয়েছেন ওর সফলতা। মেয়েকে নিয়ে আমি অনেক গর্বিত।

 

ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সাঁওতাল পরিবারের সন্তান কোহাতি কিসকো। রাঙ্গাটুঙ্গী গ্রামে বসবাস করেন তিনি। তার বড় বোন ইপিনা কিসকো বলেন, ‘চ্যাম্পিয়ন নারী দলকে শুভেচ্ছা। এই দলে আমার বোনো আছে। আমার বোন যখন খেলা শুরু করেছিল, তখন হাফপ্যান্ট পড়ায় অনেকে টিটকারি করেছিল। অনেকে হিংসাও করতো। আজ চ্যাম্পিয়ন হওয়ায় সেই মানুষরাই আমাকে এই গল্প শোনাতে আসে। আমার বোনের অনেক প্রসংশা করে তারা।

 

কোহাতির বড় বোন সোহাগি কিসকো ২০২২ সাফ নারী চ্যাম্পিয়ান দলের সদস্য। তিনি বলেন, ‘আমার দেশ-আমার দল এবারও জিতেছে। আমার অনেক ভালো লাগছে। এবার আমি দলে থাকতে পারিনি। তবে, সেটা নিয়ে আমার কোনো কষ্ট নেই। কারণ আমার ছোট বোন এবার সেই দলে ছিলো। ওদের সফল হতে দেখে আমার খুব ভালো লাগছে।’

 

গরিব পরিবারের সন্তান সাগরিকা। রাঙ্গাটুঙ্গী গ্রামে বাসিন্দা করেন তিনিও। তার বাবা পেশায় চায়ের দোকানি। দুই সন্তানের মধ্যে সাগরিকা ছোট। ছেলে মোহাম্মদ সাগর একটি ইটের ভাটায় কাজ করেন।

 

সাগরিকার বাবা লিটন জানান, মেয়েদের ফুটবল খেলা দেখে অনেকেই কটূক্তি করতেন। তাদের কথায় বিরক্ত হয়ে মেয়েকে মাঠে যেতে বারণ করে ঘরে আটকে রাখেন। এসব উপেক্ষা করে মাঠে চলে যেতেন সাগরিকা। এক সময় রাঙ্গাটুঙ্গী ইউনাইটেড ফুটবল একাডেমির প্রতিষ্ঠাতা তাজুল ইসলামের অনুরোধকে গুরুত্ব দিতে বাধ্য হন লিটন-আনজু দম্পতি। এরপর ধিরে ধিরে সাগরিকার খেলায় উন্নতি হয়।

 

সাফ চ্যাম্পিয়ন সাগরিকার প্রতিবেশী আক্কাস বলেন,আমি এবার সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের প্রতিটি খেলাই দেখেছি। আমার বোন খেলেছে। আমার খুব ভালো লাগছে। জয়ী দলের প্রতিটি খেলোয়ারকে জানাই অভিনন্দন।

 

রাঙ্গাটুঙ্গী ইউনাইটেড প্রমিলা ফুটবল একাডেমির পরিচালক তাইজুল ইসলাম এই তিন ফুটবল রত্নের গল্প শুনিয়েছেন। তিনি বলেন,দেশের নারী ফুটবল উন্নয়নে আমি  এই ফুটবল একাডেমি প্রতিষ্ঠা করি। প্রথমদিকে কোনো পরিবার তাদের মেয়েদের ফুটবল খেলতে অনুমতি দিচ্ছিল না। স্বপ্না রাণীর মতো সব মেয়েদের পরিবারকে আমি অনেক অনুরোধ করে রাজি করাই। এলাকার মেয়েদের নিজ খরচে ফুটবল খেলতে শেখাই। এভাবেই আস্তে আস্তে আমার একাডেমি থেকে এখন পর্যন্ত ১৬ জন মেয়ে বিভিন্ন সময়ে জাতীয় দলে খেলেছে।

 

তাজুল ইসলাম মনে করেন, বাংলাদেশ সরকার নারী ফুটবল উন্নয়নে আরো বেশি মনোযোগী হলে দেশের নারীরা বাংলাদেশকে বিশ্ব জয়ের স্বাদ এনে দিতে পারবে। সেইসাথে ফুটবল খেলুড়ে মেয়েদের আর্থিক উন্নয়নে কাজ করতে পারলে আরো বেশি মেয়েরা এই খেলায় আগ্রহী হবে।

 

 

ঠাকুরগাঁও জেলা প্রশাসক ইসরাত ফারজানা বলেন,বাংলাদেশ নারী ফুটবল দলকে অভিনন্দন। চ্যাম্পিয়ন দলে ঠাকুরগাঁও জেলার তিন মেয়ে খেলছেন। এটা আমাদের জন্যে অনেক গর্বের। আমি কিছুদিন আগেই সেই খেলার মাঠে গিয়েছিলাম। ফুটবল একাডেমি উন্নয়নে সার্বিকভাবে সহযোগিতা করবে ঠাকুরগাঁও প্রশাসন।


প্রিন্ট
Tag :
এই অথরের আরো সংবাদ দেখুন

জনপ্রিয় সংবাদ

তানোরের গোল্লাপাড়া বাজার বণিক সমিতির নির্বাচন

error: Content is protected !!

ঠাকুরগাঁওয়ের মাটির কুঁড়েঘর থেকেই উঠে আসা তিন নারী ফুটবলার

আপডেট টাইম : ০১:৫৯ অপরাহ্ন, সোমবার, ৪ নভেম্বর ২০২৪
জসীমউদ্দীন ইতি, ঠাকুরগাঁও জেলা প্রতনিধি :

মাটির কুঁড়েঘর থেকেই জ্বলন্ত পিদিমের মতো আলো ছড়িয়েছেন ঠাকুরগাঁওয়ের প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে উঠে আসা তিন নারী ফুটবলার। সেই আলো বাংলাদেশের গণ্ডি পেরিয়ে আলোকিত করেছে সারা বিশ্ব। তবে, বাতির নিচের অন্ধকারের গল্পের মতোই তাদের জীবনের বাস্তবতা। ফুটবল খেলে দেশের নারী ফুটবলের ভাগ্য পরিবর্তন করলেও পরিবর্তন করতে পারেননি নিজ পরিবারের ভাগ্য। এখনো প্রত্যন্ত অজপাড়া গ্রামের মাটির জীর্ণ ঝুপড়ি ঘরেই বসবাস করছে স্বপ্না রাণী, কোহাতি কাসকো ও সাগরিকাদের পরিবার।

 

অত্যন্ত গরিব পরিবারে বেড়ে উঠা স্বপ্না রাণী ২০১৯ সালে অনূর্ধ্ব-১৭ বয়সভিত্তিক দলে প্রথম সুযোগ পান। এরপর ভারতের ঝাড়খন্ড রাজ্যের জামশেদপুরে গত মার্চ মাসে সাফ অনূর্ধ্ব-১৮ টুর্নামেন্টে অসাধারণ পারফরম্যান্স করেন তিনি। ২০২২ ও ২০২৪ সাফ নারী চ্যাম্পিয়ন দলে খেলেছেন। দেশের জন্যে মুকুট জয়ে পালন করেছেন গুরু দায়িত্ব। অপর দুই জন কোপাতি ও সাগরিকাও ২০২৪ সাফ নারী চ্যাম্পিয়ান দলের গর্বিত সদস্য।

 

এই তিন জনেরই বেড়ে ওঠা ঠাকুরগাঁওয়ের রাণীশংকৈল উপজেলার অজপাড়াগাঁয়ে। পাশাপাশি গ্রামের তিন জনই উঠে এসেছেন রাঙ্গাটুঙ্গী গ্রামে গড়ে ওঠা একটি ফুটবল একাডেমি থেকে।

 

স্বপ্না রাণীর বাড়ি শিয়ালডাঙ্গি গ্রামে। এখানে দুটি মাটির ঘরে বসবাস করে তার পরিবার। স্বপ্নার শোবার ঘরে দুইটি চৌকি, একটি টিনের বাক্স ও ছোট একটি কাঠের শোকেজ রয়েছে। বিভিন্ন সময়ে ফুটবল খেলে পাওয়া পুরস্কার রাখার যায়গা নেই ঘরটিতে। তাই স্বপ্নার সব পুরস্কার বস্তায় ভরে টিনের বাক্সতে রেখে দিয়েছেন পরিবারের সদস্যরা। স্বপ্নার বড় বোন কৃষ্ণা রানী স্থানীয় একটি দরজির দোকানের কাজ করেন। তার আয় করা টাকাতেই চলে সংসারের খরচ।

 

স্বপ্না রাণীর বাবা নিরেন চন্দ্র বলেন,আমার মেয়ে অনেক কষ্ট করে আজ এই পর্যন্ত পৌঁছেছে। এলাকার তাইজুল স্যার জোর করে খেলতে নিয়ে গিয়ে তাকে এতবড় অর্জন এনে দিয়েছেন। বাসায় ডিসের লাইন না থাকায় মেয়ের খেলা দেখতে পারিনি। প্রতিবেশীরা আমাকে জানিয়েছেন ওর সফলতা। মেয়েকে নিয়ে আমি অনেক গর্বিত।

 

ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সাঁওতাল পরিবারের সন্তান কোহাতি কিসকো। রাঙ্গাটুঙ্গী গ্রামে বসবাস করেন তিনি। তার বড় বোন ইপিনা কিসকো বলেন, ‘চ্যাম্পিয়ন নারী দলকে শুভেচ্ছা। এই দলে আমার বোনো আছে। আমার বোন যখন খেলা শুরু করেছিল, তখন হাফপ্যান্ট পড়ায় অনেকে টিটকারি করেছিল। অনেকে হিংসাও করতো। আজ চ্যাম্পিয়ন হওয়ায় সেই মানুষরাই আমাকে এই গল্প শোনাতে আসে। আমার বোনের অনেক প্রসংশা করে তারা।

 

কোহাতির বড় বোন সোহাগি কিসকো ২০২২ সাফ নারী চ্যাম্পিয়ান দলের সদস্য। তিনি বলেন, ‘আমার দেশ-আমার দল এবারও জিতেছে। আমার অনেক ভালো লাগছে। এবার আমি দলে থাকতে পারিনি। তবে, সেটা নিয়ে আমার কোনো কষ্ট নেই। কারণ আমার ছোট বোন এবার সেই দলে ছিলো। ওদের সফল হতে দেখে আমার খুব ভালো লাগছে।’

 

গরিব পরিবারের সন্তান সাগরিকা। রাঙ্গাটুঙ্গী গ্রামে বাসিন্দা করেন তিনিও। তার বাবা পেশায় চায়ের দোকানি। দুই সন্তানের মধ্যে সাগরিকা ছোট। ছেলে মোহাম্মদ সাগর একটি ইটের ভাটায় কাজ করেন।

 

সাগরিকার বাবা লিটন জানান, মেয়েদের ফুটবল খেলা দেখে অনেকেই কটূক্তি করতেন। তাদের কথায় বিরক্ত হয়ে মেয়েকে মাঠে যেতে বারণ করে ঘরে আটকে রাখেন। এসব উপেক্ষা করে মাঠে চলে যেতেন সাগরিকা। এক সময় রাঙ্গাটুঙ্গী ইউনাইটেড ফুটবল একাডেমির প্রতিষ্ঠাতা তাজুল ইসলামের অনুরোধকে গুরুত্ব দিতে বাধ্য হন লিটন-আনজু দম্পতি। এরপর ধিরে ধিরে সাগরিকার খেলায় উন্নতি হয়।

 

সাফ চ্যাম্পিয়ন সাগরিকার প্রতিবেশী আক্কাস বলেন,আমি এবার সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের প্রতিটি খেলাই দেখেছি। আমার বোন খেলেছে। আমার খুব ভালো লাগছে। জয়ী দলের প্রতিটি খেলোয়ারকে জানাই অভিনন্দন।

 

রাঙ্গাটুঙ্গী ইউনাইটেড প্রমিলা ফুটবল একাডেমির পরিচালক তাইজুল ইসলাম এই তিন ফুটবল রত্নের গল্প শুনিয়েছেন। তিনি বলেন,দেশের নারী ফুটবল উন্নয়নে আমি  এই ফুটবল একাডেমি প্রতিষ্ঠা করি। প্রথমদিকে কোনো পরিবার তাদের মেয়েদের ফুটবল খেলতে অনুমতি দিচ্ছিল না। স্বপ্না রাণীর মতো সব মেয়েদের পরিবারকে আমি অনেক অনুরোধ করে রাজি করাই। এলাকার মেয়েদের নিজ খরচে ফুটবল খেলতে শেখাই। এভাবেই আস্তে আস্তে আমার একাডেমি থেকে এখন পর্যন্ত ১৬ জন মেয়ে বিভিন্ন সময়ে জাতীয় দলে খেলেছে।

 

তাজুল ইসলাম মনে করেন, বাংলাদেশ সরকার নারী ফুটবল উন্নয়নে আরো বেশি মনোযোগী হলে দেশের নারীরা বাংলাদেশকে বিশ্ব জয়ের স্বাদ এনে দিতে পারবে। সেইসাথে ফুটবল খেলুড়ে মেয়েদের আর্থিক উন্নয়নে কাজ করতে পারলে আরো বেশি মেয়েরা এই খেলায় আগ্রহী হবে।

 

 

ঠাকুরগাঁও জেলা প্রশাসক ইসরাত ফারজানা বলেন,বাংলাদেশ নারী ফুটবল দলকে অভিনন্দন। চ্যাম্পিয়ন দলে ঠাকুরগাঁও জেলার তিন মেয়ে খেলছেন। এটা আমাদের জন্যে অনেক গর্বের। আমি কিছুদিন আগেই সেই খেলার মাঠে গিয়েছিলাম। ফুটবল একাডেমি উন্নয়নে সার্বিকভাবে সহযোগিতা করবে ঠাকুরগাঁও প্রশাসন।


প্রিন্ট