বাড়ির পাশে নীরবে শুয়ে আছে আবরার। প্রতিদিন সেদিকে ছুটে যায় তার মা। দূর থেকে দাঁড়িয়ে ডুকরে ডুকরে কাঁদেন। কারো পায়ের শব্দ পেলেই আঁচলে মুখ ঢাকেন। পরক্ষণেই ছুটে আসেন বাড়িতে। মনোযোগী হতে পারেন না কোনো কাজেই। ভাবেন, এই বুঝি আবরার বাড়িতে আসলো ,মা বলে ডাক দিলো।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যার পাঁচ বছর পূর্ণ হলো আজ। অথচ তাঁর মা রোকেয়া খাতুনের কাছে মনে হচ্ছে, এ যেন সেদিনের ঘটনা! আবরার আম্মু বলে ডাকছে, আম্মু খাবার দাও বা আম্মু এটা রান্না করো, ওটা রান্না করো। আবরারের স্মৃতি আঁকড়ে ধরে এখনো ঘরের কোনায় কোনায় কেঁদে বেড়ান তিনি। তাঁর কান্না থামতেই চায় না। আবরারের বাবা, মা ও একমাত্র ছোট ভাই কুষ্টিয়া শহরে থাকেন। বাবা বরকত উল্লাহ বিশেষ প্রয়োজনে কুষ্টিয়ার বাইরে রয়েছেন। ছোট ভাই আবরার ফায়াজ বুয়েটে পড়েন।
মা বসে থাকেন। ভাবেন আবরার ফিরে আসবে। মা বলে ডাকবে। কিন্তু না, আবরার আর আসে না। মায়ের অভিমানী মন তখন ভাবে, আবরার হয়তো মাকে ভুলে গেছে। কাছে আসে না, মা বলে ডাকেও না। হয়তো মা বলে ডাকতেও চায় না।
মা রোকেয়া খাতুন বলেন, কিন্তু আমি তো মা। আমি তো আর ভুলে থাকতে পারি না। সব সময় মনে পড়ে ছেলের কথা। আবরারের মা রোকেয়া খাতুন আরো বলেন, পাঁচ বছর চলে গেলো। মনে বড় কষ্ট। আবরারের সমবয়সীরা কেউ চাকরি করছে। কেউ বিয়ে করেছে। কয়েকদিন হলো একজনের বিয়ের দাওয়াত থেকে আসলাম। কারো আবার সন্তানও আছে। আমার ছেলেটা থাকলেও হয়তো চাকরি করতো, বিয়ে করতো। বিভিন্ন কারণে কষ্ট পাচ্ছি। বুকটা হাহাকার করে।
আবরারের বাবা বরকতুল্লাহ জানান, আবরারের কথা চিন্তা করতে করতে অসুস্থ হয়ে পড়েছে ওর মা। ছেলের কথা মনে করে প্রায় সে কান্না করে। সব সময় আবরারের কথা মনে করে।
তিনি বলেন, পাঁচ বছর হয়ে গেলো। ছেলেটাকে কি নির্মমভাবে পিটিয়ে মেরে ফেলে। এ কথা মনে পড়লে আর ভালো লাগে না। দুঃখ কষ্টের মধ্য দিয়ে সময় যাচ্ছে। মামলাটা উচ্চ আদালতে আসামিদের ডেথ রেফারেন্স শুনানির অপেক্ষায় আছে। আশা করছি, মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি হবে। নিম্ন আদালতের রায় উচ্চ আদালতে বহাল থাকবে।
বুয়েটের একটা হলের নাম আবরারের নামে করার প্রত্যাশা ব্যক্ত করে বরকতুল্লাহ বলেন, ছাত্ররা এ দাবি আগে থেকে করে আসছে। কিন্তু ওরা (বুয়েট কর্তৃপক্ষ) কিছু করছে না। তিনি আরো বলেন, সরকার পরিবর্তন হয়েছে। আগের সরকার যদি দেশকে ঠিকমত শাসন করতো, ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করতো তাহলে হাজার হাজার মায়ের বুক খালি হতো না। ওবায়দুল কাদের যদি তখন ছাত্রলীগকে লেলিয়ে না দিতেন তাহলে এতো প্রাণহানি ঘটতো না। তাদের কারণে হাজার হাজার মা-বাবা আমার মতো কষ্ট পাচ্ছে। সবার হত্যারই বিচার হওয়া দরকার। ছাত্র রাজনীতির কারণে এতো বড় ক্ষতি হয়ে গেলো। হাজার হাজার মা-বাবা সন্তান হারা হলো। আমি যেমন কষ্ট পাচ্ছি, তারাও পাচ্ছে।
উল্লেখ্য, ২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর রাতে বুয়েটের শেরেবাংলা হলে আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় ১৯ জনকে আসামি করে পরের দিন ৭ অক্টোবর চকবাজার থানায় একটি হত্যা মামলা করেন আবরার ফাহাদের বাবা বরকতুল্লাহ। ওই বছরের ১৩ নভেম্বর ২৫ জনকে অভিযুক্ত করে অভিযোগপত্র দাখিল করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ঢাকা মহানগর (দক্ষিণ) গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) পরিদর্শক ওয়াহেদুজ্জামান।
২০২০ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর ২৫ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের মাধ্যমে বিচার শুরু করেন। ২০২১ সালের বছর ৮ ডিসেম্বর আবরার হত্যা মামলায় ২০ আসামিকে মৃত্যুদণ্ড এবং পাঁচ আসামির যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ দেন ঢাকার তৎকালীন এক নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক আবু জাফর মো. কামরুজ্জামান।
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন-অনিক সরকার, ইফতি মোশাররফ সকাল, মো. মেফতাহুল ইসলাম জিয়ন, মেহেদী হাসান রবিন, মো. মনিরুজ্জামান মনির, খন্দকার তাবাখখারুল ইসলাম তানভীর, শিক্ষার্থী মো. মুজাহিদুর রহমান ও এএসএম নাজমুস সাদাত, মেহেদী হাসান রাসেল, মুনতাসির আল জেমি, আবরারের রুমমেট মিজানুর রহমান, শাসছুল আরেফিন রাফাত, মো. মাজেদুর রহমান মাজেদ, শামীম বিল্লাহ, হোসেন মোহাম্মাদ তোহা, মোর্শেদ অমত্য ইসলাম ও এস এম মাহমুদ সেতু, মোর্শেদ-উজ-জামান মন্ডল ওরফে জিসান, এহতেশামুল রাব্বি ওরফে তানিম ও মুজতবা রাফিদ।
যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রাপ্তরা হলেন-অমিত সাহা, মুহতামিম ফুয়াদ, ইশতিয়াক আহম্মেদ মুন্না, আকাশ হোসেন ও মুয়াজ ওরফে আবু হুরায়রা।
আজ সোমবার সকালে কুষ্টিয়া শহরের পিটিআই সড়কের পাশে আবরারের বাড়িতে গেলে মা রোকেয়া খাতুনের সঙ্গে কথা হয়। বাড়িতে তিনি একাই ছিলেন। আবরারের একমাত্র ছোট ভাই আবরার ফাইয়াজ বুয়েটে যন্ত্র কৌশলে দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। আবরার ফাহাদের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে বুয়েটে কয়েকটি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে তাঁর বাবা বরকত উল্লাহ ঢাকায় গেছেন।
কথা হলে অশ্রুসিক্ত চোখ আবরারের মা রোকেয়া খাতুন বলেন, ‘পাঁচ বছর আগে এই দিনে ছেলেকে সকালে গাড়িতে উঠিয়ে দিয়েছিলাম। বিকেলে বুয়েটে পৌঁছায়। এরপর তাঁকে ছাত্রলীগের ছেলেরা ডেকে রাতভোর নির্যাতন করে হত্যা করেছিল। তাঁরা ছাত্রলীগ করলেও তারই কয়েকজন বন্ধু ছিল। তাঁরাও একটি বারের জন্যও ফোনে জানায়নি ছেলে নিহত হওয়ার বিষয়ে।’
আবরারের মা শোকেস থেকে একটি ল্যাপটপ ও দুটি মোবাইল ফোন বের করে দুই হাতে নেড়েচেড়ে বলেন, এগুলো ছেলের। যত্নে রেখেছি আজও। সেগুলো আবারও শোকেসের ভেতরে রাখলেন। তিনি আরও বলেন, জানো, আজ যদি আমার ছেলে বেঁচে থাকত তাহলে চাকরি করত। আরও কত কী হতো।এভাবেই স্মৃতিচারণ করতে থাকেন মা রোকেয়া খাতুন।
তিনতলার বাড়ির নিচতলাতে থাকে আবরারের পরিবার। একটি কক্ষে বেশ পরিপাটি করে সাজানো। খাটের একপাশে বড় একটি শোকেস।
শোকেসের ভেতর হাতঘড়ি থেকে শুরু করে ব্যাগ বইপত্র, প্রসাধনী, আইডিকার্ডসহ আরও অনেক কিছুই যত্নে রেখেছেন। জুতা, একটি গ্লোব, পোশাক, জায়নামাজ ও তাসবিহ রয়েছে। কিছু চকলেট দেখিয়ে আবরারের মা বলেন, আবরার ঘুমানোর সময় চকলেট মুখে দিয়ে ঘুমাত।’ এইগুলো পাঁচ বছর ধরে আগলে রেখেছেন তিনি। হাতঘড়ির কাটা বন্ধ হয়ে গেছে।
আবরার সব সময় দেশের ভালোর জন্য লিখতেন। দেশ নিয়ে ভাবতেন। দেশের স্বার্থে ভালো কিছু লিখেই তিনি একটি দলের কাছে শত্রু হয়ে গিয়েছিলেন।
মোবাইল ফোনে আবরারের বাবা বরকত উল্লাহ জানান, তিনি ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক আসামিদের গ্রেপ্তার চেয়েছেন। এ ছাড়া যেসব আসামি কারাগারে রয়েছেন তাঁদের রায় দ্রুত কার্যকরের দাবি জানান।
প্রিন্ট