ঢাকা , বৃহস্পতিবার, ২০ নভেম্বর ২০২৫, ৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
প্রতিনিধি নিয়োগ
দৈনিক সময়ের প্রত্যাশা পত্রিকার জন্য সারা দেশে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে প্রতিনিধি নিয়োগ করা হচ্ছে। আপনি আপনার এলাকায় সাংবাদিকতা পেশায় আগ্রহী হলে যোগাযোগ করুন। Hotline- +880 9617 179084

অঘ্রানের আলোয় নবান্নের উল্লাস, ঘরে ঘরে উৎসব

গোলাম মোর্তবা রিজুঃ

 

আজ পহেলা অগ্রহায়ণ। শুরু হলো নবান্নের উৎসব। শিশিরস্নাত সকালে সোনালী ধানের সমুদ্রের ঢেউ। পাকা ধানের ঘ্রাণে ভরে উঠেছে চারদিক, ধানের শীষে দুলছে সোনালী হাসি। অগ্রহায়ণ মাস এলেই বাংলার প্রকৃতি যেন এক অনন্য রূপে ধরা দেয়।

 

শীতের হিমেল হাওয়া, ভোরের শিশিরে ভেজা সবুজ-হলুদ ধানক্ষেত আর কৃষকের মুখের তৃপ্তির হাসি—সব মিলিয়ে গ্রামবাংলায় শুরু হয় নবান্নের উল্লাস।

 

নবান্ন শুধু নতুন ধানের উৎসব নয়; এটি বাংলার মানুষের পরিশ্রম, আশা, ঐতিহ্য আর নিবিড় জীবনের চিত্র। অগ্রহায়ণ মাসের শুরুর সঙ্গে সঙ্গে যে শস্যঋতুর আগমন ঘটে, তার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে ধান কাটা, ঘরে তোলা এবং নতুন ফসলের শুভ সূচনা।

 

বছরের প্রায় নয়-দশ মাস কৃষক পরিবারের অপেক্ষা থাকে এই সময়টির জন্য। ধান যখন সোনালি রঙে মোড়া হয়ে ওঠে, কৃষক তখন বুঝতে পারেন—শস্যের ভাণ্ডার পূর্ণ হওয়ার সময় এসেছে।

 

শুকনো হাওয়ার স্পর্শে যখন গাছের পাতা ঝরা শুরু হয়। তখন বাংলার গাঁও-গেরামে শুরু হয় ধান কাটার উচ্ছ্বাস। ভোরের আলো ফুটতেই কৃষক-পুরুষ, নারী, এমনকি তরুণরাও দল বেঁধে নামে ধানক্ষেতে। হাতে কাচি, মাথায় খড়ের টুপি বা গামছা, পা ভিজে মাটিতে ধান কাটার প্রতিটি মুহূর্ত যেন কৃষকের কাছে আনন্দের।

 

কাঁচির টুংটাং শব্দে ভরে ওঠে মাঠ—এই শব্দই বছরের পর বছর গ্রামবাংলার কৃষিজীবনের সুর। ধান কাটার সঙ্গে জড়িয়ে আছে এক ধরনের সম্মিলিত পরিশ্রম, যা বাঙালির গ্রামীণ সামাজিক কাঠামোকে আরও দৃঢ় করে। কাটার পর গোল করে বাঁধা ধানের আঁটি মাঠেই শুকোতে দেওয়া হয়। তারপর গরুর সাহায্যে কিংবা মেশিনে ধান মাড়াই হয়। ধানের গন্ধ, খড়ের গন্ধ, সকালের শীতল বাতাস সব মিলিয়ে সৃষ্ট হয় এক অব্যক্ত সুখের অনুভূতি।

 

নতুন ধান ঘরে তোলার পরই শুরু হয় ‘নবান্ন’। ‘নব’ অর্থ নতুন, আর ‘অন্ন’ অর্থ খাদ্য। অর্থাৎ নতুন ফসলের অন্নকে ঘিরে আনন্দ-অনুষ্ঠান।

 

বাংলার ঘরে ঘরে এই সময় তৈরি হয় নানা পিঠা, পায়েস, মুড়কি, চিতই বা ভাজা চালের নানা পদ। বিশেষ করে নতুন চালের পায়েস নবান্নের অপরিহার্য অংশ। এই নতুন ধানের অন্ন প্রথমে উৎসর্গ করা হয় দেব-দেবীর উদ্দেশ্যে। তারপর কৃষক পরিবার সেটি ভাগ করে খায়। এতে থাকে কৃতজ্ঞতা, আশীর্বাদ আর নতুন বছরের ভালো ফসলের প্রত্যাশা।

 

নবান্ন উৎসব মূলত কৃষকের ঘর থেকেই শুরু হলেও এটি এখন বাঙালির সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যেরও অংশ। শহরেও নানা সাংস্কৃতিক সংগঠন নবান্নের আয়োজন করে। গান, নাচ, কবিতা পাঠ, পিঠা উৎসব ইত্যাদির মধ্য দিয়ে নতুন ফসলের আনন্দ ভাগ করে নেওয়া হয়। নবান্নের মাধ্যমে বাঙালি মনে করিয়ে দেয়—মাটির সঙ্গে তার টান, কৃষকের প্রতি শ্রদ্ধা, আর প্রকৃতির প্রতি কৃতজ্ঞতা আজও অটুট।

 

অগ্রহায়ণ মাসের শিশিরভেজা সকাল থেকে নতুন ধান ওঠার মুহূর্ত পর্যন্ত নবান্ন এক অনির্বচনীয় আবেগ। আধুনিকতার ব্যস্ততায় অনেক কিছুই পাল্টে গেছে, কিন্তু ধান কাটার সোনালি দৃশ্য এবং নতুন ফসলের আনন্দ আজও বাঙালির চিরন্তন উৎসবের অংশ হয়ে আছে।


প্রিন্ট
Tag :
এই অথরের আরো সংবাদ দেখুন

জনপ্রিয় সংবাদ

বেনাপোল পৌরসভার ৮ নং ওয়ার্ডে মফিকুল হাসান তৃপ্তি’র নির্বাচনী উঠান বৈঠক অনুষ্ঠিত

error: Content is protected !!

অঘ্রানের আলোয় নবান্নের উল্লাস, ঘরে ঘরে উৎসব

আপডেট টাইম : ৫ ঘন্টা আগে
গোলাম মোর্তবা শিকদার রিজু, বালিয়াকান্দি (রাজবাড়ী) প্রতিনিধি :

গোলাম মোর্তবা রিজুঃ

 

আজ পহেলা অগ্রহায়ণ। শুরু হলো নবান্নের উৎসব। শিশিরস্নাত সকালে সোনালী ধানের সমুদ্রের ঢেউ। পাকা ধানের ঘ্রাণে ভরে উঠেছে চারদিক, ধানের শীষে দুলছে সোনালী হাসি। অগ্রহায়ণ মাস এলেই বাংলার প্রকৃতি যেন এক অনন্য রূপে ধরা দেয়।

 

শীতের হিমেল হাওয়া, ভোরের শিশিরে ভেজা সবুজ-হলুদ ধানক্ষেত আর কৃষকের মুখের তৃপ্তির হাসি—সব মিলিয়ে গ্রামবাংলায় শুরু হয় নবান্নের উল্লাস।

 

নবান্ন শুধু নতুন ধানের উৎসব নয়; এটি বাংলার মানুষের পরিশ্রম, আশা, ঐতিহ্য আর নিবিড় জীবনের চিত্র। অগ্রহায়ণ মাসের শুরুর সঙ্গে সঙ্গে যে শস্যঋতুর আগমন ঘটে, তার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে ধান কাটা, ঘরে তোলা এবং নতুন ফসলের শুভ সূচনা।

 

বছরের প্রায় নয়-দশ মাস কৃষক পরিবারের অপেক্ষা থাকে এই সময়টির জন্য। ধান যখন সোনালি রঙে মোড়া হয়ে ওঠে, কৃষক তখন বুঝতে পারেন—শস্যের ভাণ্ডার পূর্ণ হওয়ার সময় এসেছে।

 

শুকনো হাওয়ার স্পর্শে যখন গাছের পাতা ঝরা শুরু হয়। তখন বাংলার গাঁও-গেরামে শুরু হয় ধান কাটার উচ্ছ্বাস। ভোরের আলো ফুটতেই কৃষক-পুরুষ, নারী, এমনকি তরুণরাও দল বেঁধে নামে ধানক্ষেতে। হাতে কাচি, মাথায় খড়ের টুপি বা গামছা, পা ভিজে মাটিতে ধান কাটার প্রতিটি মুহূর্ত যেন কৃষকের কাছে আনন্দের।

 

কাঁচির টুংটাং শব্দে ভরে ওঠে মাঠ—এই শব্দই বছরের পর বছর গ্রামবাংলার কৃষিজীবনের সুর। ধান কাটার সঙ্গে জড়িয়ে আছে এক ধরনের সম্মিলিত পরিশ্রম, যা বাঙালির গ্রামীণ সামাজিক কাঠামোকে আরও দৃঢ় করে। কাটার পর গোল করে বাঁধা ধানের আঁটি মাঠেই শুকোতে দেওয়া হয়। তারপর গরুর সাহায্যে কিংবা মেশিনে ধান মাড়াই হয়। ধানের গন্ধ, খড়ের গন্ধ, সকালের শীতল বাতাস সব মিলিয়ে সৃষ্ট হয় এক অব্যক্ত সুখের অনুভূতি।

 

নতুন ধান ঘরে তোলার পরই শুরু হয় ‘নবান্ন’। ‘নব’ অর্থ নতুন, আর ‘অন্ন’ অর্থ খাদ্য। অর্থাৎ নতুন ফসলের অন্নকে ঘিরে আনন্দ-অনুষ্ঠান।

 

বাংলার ঘরে ঘরে এই সময় তৈরি হয় নানা পিঠা, পায়েস, মুড়কি, চিতই বা ভাজা চালের নানা পদ। বিশেষ করে নতুন চালের পায়েস নবান্নের অপরিহার্য অংশ। এই নতুন ধানের অন্ন প্রথমে উৎসর্গ করা হয় দেব-দেবীর উদ্দেশ্যে। তারপর কৃষক পরিবার সেটি ভাগ করে খায়। এতে থাকে কৃতজ্ঞতা, আশীর্বাদ আর নতুন বছরের ভালো ফসলের প্রত্যাশা।

 

নবান্ন উৎসব মূলত কৃষকের ঘর থেকেই শুরু হলেও এটি এখন বাঙালির সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যেরও অংশ। শহরেও নানা সাংস্কৃতিক সংগঠন নবান্নের আয়োজন করে। গান, নাচ, কবিতা পাঠ, পিঠা উৎসব ইত্যাদির মধ্য দিয়ে নতুন ফসলের আনন্দ ভাগ করে নেওয়া হয়। নবান্নের মাধ্যমে বাঙালি মনে করিয়ে দেয়—মাটির সঙ্গে তার টান, কৃষকের প্রতি শ্রদ্ধা, আর প্রকৃতির প্রতি কৃতজ্ঞতা আজও অটুট।

 

অগ্রহায়ণ মাসের শিশিরভেজা সকাল থেকে নতুন ধান ওঠার মুহূর্ত পর্যন্ত নবান্ন এক অনির্বচনীয় আবেগ। আধুনিকতার ব্যস্ততায় অনেক কিছুই পাল্টে গেছে, কিন্তু ধান কাটার সোনালি দৃশ্য এবং নতুন ফসলের আনন্দ আজও বাঙালির চিরন্তন উৎসবের অংশ হয়ে আছে।


প্রিন্ট