ইলিশের ডিম খেয়ে সেই যে দৌলতদিয়া ঘাটে ধরা খেয়েছিলাম, তারপর কেটে গেছে চারটি বছর। এবারের অকুস্থল ঢাকার গুলিস্তান।
ফার্সী শব্দ "গুলিস্তাঁ" অর্থ ফুলের বাগান হলেও, এখানে কবে ফুলের বাগান ছিল, আর কবেই বা ফুলের স্থান দখল করেছে চোর, পকেটমার আর 'গলাকাটা' বিক্রেতারা সে খবর আমজনতা জানে না।
আমজনতার মুখে শোনা যায় গুলিস্তান সম্পর্কে নানা মুখরোচক গল্প। তার দু' একটা বলি। এক ভদ্রলোক একবার ঘড়িসহ ডান হাত বিমানের জানালা দিয়ে বের করে বোঝার চেষ্টা করছিলেন যে, বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে কি না। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ভদ্রলোকের খেয়াল হলো যে ঘড়ি ভিজে নষ্ট হয়ে যেতে পারে। অমনি হাত দ্রুত ভিতরে নিয়ে আসলেন। কিন্তু দেখেন, হাতে ঘড়ি নাই! তখনই পাইলটের ঘোষণা শোনা গেলো, এইমাত্র আমরা ঢাকার গুলিস্তান এলাকা অতিক্রম করলাম।
আরেকটা গল্প ছিলো এ রকম – গুলিস্তান সিনেমা হলের সামনে দাঁড়িয়ে এক বন্ধু আরেক বন্ধুকে বলছে, গুলিস্তানের পকেটমাররা নাকি এতটাই প্রফেশনাল যে চেহারা দেখলেই বুঝে যায়, কার পকেট খালি আর কার পকেট টাকায় ভরা! আমিতো এই ঘন্টা দুয়েক হলো পকেট ভরা টাকা নিয়ে ঘুরছি, কেউতো ধারেকাছেও আসলো না! পাশ থেকে একজন বললো, গুলিস্তানের ওস্তাদরা পাঁচ মিনিটের মধ্যেই দেখে নিয়েছে যে পকেট ভরা টাকার সাইজের কাটা কাগজ , সেগুলো তাই আবার জায়গামতো রেখে দিয়েছে।
তো সেই গুলিস্তানেতো কতবারই যাওয়া পড়েছে আমার কিংবা আপনার। কিন্তু সেবারের যাওয়াটা কেন আলাদা করে মনে আছে তা শুনলেই বুঝতে পারবেন। গুলিস্তানে পৌঁছানোর আগে অবশ্য একটু পটভূমি বর্ণনা করে নিতে হবে –
বোয়ালমারী নিবাসী কবি ও সাংবাদিক কাজী কামরুল হাসান ফিরোজ তখনও কাজী হাসান ফিরোজ নাম ধারণ করেননি। সাপ্তাহিক চন্দনা তখনও আলোর মুখ দেখেনি। ১৯৯২ কিংবা ৯৩ সালের কথা। সেটেলমেন্টের চাকরি ছেড়ে দিয়ে আমি উঠেছি বুবুর বাসায়, ঢাকায়। ঠিকানা : ১০১ রায়েরবাজার (২য় তলা), ঢাকা–১২০৯, রায়েরবাজার হাইস্কুলের বিপরীতে।
খালিদ হাসান নামে এক ব্যক্তি তখন "গণ উন্নয়ন ট্রাস্ট" নামে বিরাট প্রতিষ্ঠান খুলে "দৈনিক ভোর" পত্রিকা প্রকাশ করতে শুরু করেছেন। সাহিত্যপ্রেমী মেধাবী তরুণদের নানা স্বপ্ন দেখিয়ে দলে ভেড়াচ্ছেন। আমার ভাগ্নে আশীক মোস্তফাও ভিড়ে গেছে সে দলে। ভাগ্নে একদিন আমাকে সাথে করে নিয়ে খালিদ হাসান সাহেবের সাথে পরিচয় করিয়ে দিল, আর রঙচঙ লাগিয়ে আমার নানা "গুণ" আর "কীর্তি"র বর্ণনা দিতে লাগলো। যে "গুণ"কে হাইলাইট করা হলো, সেটি হচ্ছে, মামা ঢাকা নগরীর এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে হেঁটেই চলতে পারে!
খালিদ হাসান আমাকে প্রথম পাঠালেন দৈনিক ভোরের "বিদেশ" ডেক্সে। সেখানে বিদেশের কিছু সংবাদ ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ করে বাহবা পেলাম। নতুন নতুন অনেক কিছু শিখলাম। তার মধ্যে একটা হচ্ছে " for good" মানে "ভালোর জন্যে" নয় "চিরদিনের জন্য"।
পরদিন আমাকে পাঠানো হলো "মফস্বল" ডেক্সে। বর্তমান রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব গোলাম মওলা রনি তখন দৈনিক ভোরের মফস্বল সম্পাদক। খালিদ হাসান আমাকে বললেন, কাজ শেখো, দ্রুতই তোমাকে মফস্বল সম্পাদকের দায়িত্ব নিতে হবে। ভাগ্নে আশিক কয়েকদিনের মধ্যে পদের নাম "সহ-সম্পাদক" লিখে আমাকে একটা পরিচয়পত্রও বানিয়ে দিলো (বেতন কড়ি অবশ্য কিছু নেই )। আমি সুপারিশ করে দুজন জেলা প্রতিনিধি ও একজন উপজেলা প্রতিনিধিকে দৈনিক ভোরের কার্ড দিয়েছিলাম। তারা হচ্ছেন ফরিদপুর জেলা প্রতিনিধি প্রবীর সিকদার, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা প্রতিনিধি নন্দিতা গুহ ও বোয়ালমারী উপজেলা প্রতিনিধি কবি কাজী হাসান ফিরোজ। খালিদ হাসান সকলের সাথে প্রতারণা করে কীভাবে পালিয়ে গিয়েছিলেন সে আলোচনা পরেও করা যাবে।
কাজী হাসান ফিরোজের কার্ড রেডি করে খবর দেয়ায় তিনি ঢাকায় এলেন। উঠলেন আমার কাছে, বুবুর বাসায়। "ভোর" অফিসে নিয়ে তাকে নানা জনের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলাম। তার পরদিন ফিরোজ ভাইকে নিয়ে বেড়ালাম পুরোনো ঢাকায়। ফেরার পথে গুলিস্তানে এসে ভাবলাম, বাসায় ফিরতেতো দেরি হবে, এখানে কিছু খেয়ে নেই। টাকাপয়সা কারো কাছেই এমন কিছু বেশি নেই। তাই তন্দুর রুটি আর ডাল খাওয়ার সিদ্ধান্ত হলো। ঢুকে পড়লাম কাপ্তান বাজারকে পেছনে রেখে গড়ে ওঠা সারি সারি ছাপড়া হোটেলের একটিতে।
দৌলতদিয়া ঘাটে ইলিশের ডিম খেয়ে "ধরা খাওয়ার" পর থেকে খুব সতর্ক থাকি। তাই ডালের দাম আগেই জিজ্ঞেস করে নিলাম (তন্দুর রুটির দাম জিজ্ঞেস করার কিছু নাই, ওটা সারা ঢাকায় একই, প্রতি পিস দুই টাকা)। ডালের দাম শুনতে চাওয়ায় ওরা যা বোঝার বুঝে নিল। ভাব নিয়ে বললো – হাফ দুই টাকা, ফুল তিন টাকা। আমি বললাম – দুই হাফ ডাল দেন আর দুটো করে তন্দুর দেন। পরে ওদের সাধাসাধিতে দুজনেই আরো একটা করে তন্দুর নিলাম।
ক্যাশে যেয়ে বিল জানতে চাইলে ম্যানেজার বেল টিপলেন। আমাদের খাইয়েছে যে ওয়েটার, সে চেঁচিয়ে বললো – দুইজন, চৌত্রিশ (টাকা)। আমাদের হিসাবে বিল আসে – দুই ডাল চার টাকা, ছয় তন্দুর বারো টাকা, মোট ষোল টাকা।
আমরা মৃদু উত্তেজিত। বললাম, চৌত্রিশ টাকা হলো কীভাবে? ওয়েটার বললো – দুই ডাল চার টাকা, ছয় তন্দুরি ত্রিশ টাকা। আমি বললাম – বলেন কি?! সব জায়গায় তন্দুর দুই টাকা করে! ওয়েটার বললো, আমাদের এগুলো স্পেশাল তন্দুর। টাকা বের করেন।
অন্য সব ওয়েটার ইতোমধ্যে এগিয়ে এসে একজোট হয়েছে। কথা বাড়াতে তাই সাহস হলো না। আমার একার পকেটে কুলালো না, ফিরোজ ভাইর পকেটেও হাত দিতে হলো। বিল মিটিয়ে তড়িঘড়ি কেটে পড়লাম!
বুঝলাম, এখন থেকে "তন্দুরের দাম"ও শুনে নিতে হবে!
"আমি যাই বঙ্গে, কপাল যায় সঙ্গে!"
সম্পাদক ও প্রকাশক: এ. এস.এম মুরসিদ (লিটু সিকদার) মোবাইল: 01728 311111