ঈদুল আজহাকে ঘিরে গতি ফিরেছে দেশের অর্থনীতিতে। এরই মধ্যে গৃহস্থ ও খামারি পর্যায়ে কুরবানির পশু বেচাকেনা জমে উঠেছে। এতে হাজার হাজার কোটি টাকা লেনদেন হচ্ছে। পশু পরিবহনসহ আনুষঙ্গিক খাতেও মোটা অঙ্কের অর্থ হাতবদল হচ্ছে। এছাড়া বাবা-মা, স্ত্রী-সন্তান কিংবা নিজ নামে গরু-ছাগল কুরবানিসহ ঈদের আনুষঙ্গিক খরচের জন্য প্রবাসীরা স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে বেশি রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন। সব মিলিয়ে সামগ্রিক অর্থনীতি চাঙা হয়ে উঠেছে। যদিও ঈদকে ঘিরে কী পরিমাণ টাকা অর্থনীতিতে যোগ হয়- এর কোনো সঠিক হিসাব নেই। তবে ব্যবসায়ীদের মতে, কুরবানির ঈদবাজারে ৭০ থেকে ৮০ হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য হতে পারে।
অনেক মানুষের জীবিকার সংস্থানও হয় এ উৎসবকে ঘিরে। অর্থনীতিবিদদের মতে, মানুষের সম্পৃক্ততা বিবেচনায় নিলেও ঈদকেন্দ্রিক অর্থনীতির গুরুত্ব অনেক। তাদের মতে, জাতীয় অর্থনীনিতে কুরবানির ঈদের গুরুত্ব বছর বছর বেড়েই চলছে। বিশেষত আমাদের মতো উদীয়মান অর্থনীতির দেশে মুসলমানদের বেশির ভাগই এখন পশু কুরবানি দেয়ার সক্ষমতা অর্জন করেছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, কুরবানির আগে ও পরে মিলিয়ে সপ্তাহ দেড়েক সময়ে বিচ্ছিন্নভাবে হাজার হাজার কোটি টাকার লেনদেন হয়। যদিও সঠিক পরিকল্পনা ও হিসাব না রাখার কারণে এ লেনদেন থেকে সরকার কতটা রাজস্ব আদায় করতে পারবে তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম জানান, কুরবানির ঈদকে কেন্দ্র করে এলোমেলোভাবে বিশাল পরিমাণের টাকা দেশের বাজারে লেনদেন হয়। এর সঠিক হিসাব রাখা খুবই কঠিন, তবে এই বিপুল পরিমাণের অর্থ পরিকল্পিতভাবে দেশের অর্থনীতিতে যুক্ত করা গেলে তা জিডিপিকে সমৃদ্ধ করবে। একই সঙ্গে এর ফলে সরকারের রাজস্ব ভাণ্ডারও সমৃদ্ধ হবে। তিনি বলেন, এর নেতিবাচক দিকও আছে। বাজারে বাড়তি টাকার প্রবাহের কারণে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাবে। আর অর্থনীতিতে এর ইতিবাচক দিক হচ্ছে, বণ্টন ব্যবস্থায় একটি পরিবর্তন হয়। এতে অধিকাংশ মানুষের কাছেই টাকা পৌঁছে যায়।
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই ও বিভিন্ন খাতের ব্যবসায়ীদের তথ্য অনুযায়ী, এবারের কুরবানির ঈদবাজারে ৭০ থেকে ৮০ হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য হতে পারে। এর মধ্যে শুধু কুরবানির পশুর বাজারেই লেনদেন হতে পারে ৫০ থেকে ৫৫ হাজার কোটি টাকা। তবে মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতির প্রভাব পড়েছে পোশাকের বাজারে। যদিও রোজার ঈদের মতো কুরবানির ঈদে পোশাকের বাজার অতটা জমজমাট থাকে না।
বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন বলেন, কুরবানির ঈদের সব ফোকাস থাকে পশুর বাজারে। পোশাক বা অন্যান্য পণ্য বাজারে ক্রেতার উপস্থিতি কম থাকে। তবে অন্যান্যবারের তুলনায় এবার এ বাজারে আশানুরূপ ক্রেতার দেখা মিলছে না। কারণ মূল্যস্ফীতির চাপ। তিনি বলেন, মানুষের হাতে টাকা বেশি নেই। যা আয় তা দিয়ে সংসার চালানোই কঠিন হয়ে পড়েছে। তারপরও যার যা সামর্থ্য রয়েছে তা দিয়ে সবার আগে কুরবানির পশু কেনাকে গুরুত্ব দেন। তবে এ ঈদে পোশাকের বাজার না জমলেও কুরবানির পশুর বাজার বেশ জমেছে।
কুরবানি ঘিরে মসলা ও খাদ্যসামগ্রীর বাজারেও বেচাকেনা চলে। সব মিলিয়ে এবারের ঈদে পোশাক ও খাদ্যসামগ্রী বিক্রি হতে পারে ১০ থেকে ১২ হাজার কোটি টাকার।
এ সময় রেমিট্যান্স আসে বেশি। কুরবানির পশু কেনার জন্য প্রবাসীরা তাদের দেশে থাকা পরিবারের সদস্যদের কাছে বেশি করে অর্থ পাঠান। এর প্রমাণও মিলেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের রেমিট্যান্স আহরণের তথ্যে। চলতি জুন মাসের প্রথম ২৫ দিনে গত মাসের চেয়ে বেশি রেমিট্যান্স এসেছে দেশে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুসারে, চলতি জুন মাসের ২৫ তারিখ পর্যন্ত প্রবাসীরা ২০০ কোটি ২ লাখ ডলার দেশে পাঠিয়েছেন। এটি গত বছরের একই মাসের প্রথম ২৩ দিনের তুলনায় ৫৭ শতাংশ বেশি। এ হিসাবে প্রতিদিন রেমিট্যান্স এসেছে গড়ে ৭ কোটি ৮১ লাখ ডলার। তবে শেষ ৫ দিনে যদি রেমিট্যান্স প্রবাহ সামান্য বেড়ে যায়, তাহলে ২ বছরের মধ্যে এটি হবে এক মাসে সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স আয়।
কুরবানির পশুর সিংহভাগই গ্রামের হওয়ায় সেখানে টাকার প্রবাহ সবচেয়ে বেশি বেড়েছে। বাড়ির গোয়াল কিংবা খামারে লালনপালন করা গরু-ছাগল বিক্রির টাকা গ্রামীণ জনপদের মানুষের হাতে আসায় তাদের মধ্যে খাদ্যসহ প্রয়োজনীয় পণ্যের কেনাকাটার হিড়িক পড়েছে। অনেকে এ টাকা থেকে বিভিন্ন সময় দোকানিদের কাছ থেকে বাকিতে নেয়া গোখাদ্য ও ওষুধপত্রের দাম পরিশোধ করছেন। ফলে সেখানকার হাটবাজারে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি নগদ অর্থের লেনদেন হচ্ছে। বাজার সংশ্লিষ্টরা জানান, ঈদুল আজহাকে ঘিরে শুধু কুরবানির পশু বেচাকেনাই নয়, এর সঙ্গে চামড়ার বাণিজ্যের দাদন লেনদেন, গরু জবাইয়ের জন্য প্রয়োজনীয় ছুরি-কাঁচি-দা-বঁটির ব্যবসা রয়েছে। গরুকে খাওয়ানোর খড় ও ভুসির দেদার বেচাকেনা হচ্ছে। জমে উঠেছে মসলা ও রেফ্রিজারেটর বা ফ্রিজের ব্যবসাও। সব মিলিয়ে প্রতিদিন একটি বিরাট অঙ্কের টাকা দেশের অর্থনীতিতে যুক্ত হচ্ছে।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, দেশের বিভিন্ন হাটে গত বছর অর্থাৎ ২০২২ সালে ৯৯ লাখ ৫০ হাজার ৭৬৩টি কুরবানির পশু বিক্রি হয়। জবাই হওয়া পশুর প্রায় অর্ধেকের মতো গরু ও মহিষ। বাকিটা ছাগল, ভেড়া এবং অন্যান্য। এ বছরও এর কাছাকাছি সংখ্যক কুরবানির পশু বিক্রি হবে। আর বিক্রি হওয়া গরু-ছাগলের ৭৫ শতাংশই কেনা হচ্ছে গরিবের কাছ থেকে, যারা কুরবানি উপলক্ষে এগুলো লালনপালন করেছেন। এতে গ্রামীণ অর্থনীতির চাকা সচল হয়ে উঠেছে। গরিবের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে। সরকারি নিয়ম অনুসারে, প্রতিটি গরু-মহিষ, দুম্বা-ছাগল কেনার সময় ক্রেতাকে হাট ইজারাদারদের হাসিল দিতে হয়। এ থেকে সরকার প্রায় একশ কোটি টাকা রাজস্ব পায়। তাছাড়া কুরবানির পশু পরিবহনের সময় বিভিন্ন সেতুতে বিশাল অঙ্কের টোল আদায় হয়। কুরবানি হওয়া ৬০ লাখ গরুর প্রতিটি চামড়ার মূল্য গড়ে ১ হাজার টাকা ধরলেও এর মূল্য হয় ৬০০ কোটি টাকা। ৪০ লাখ ছাগলের প্রতিটি চামড়ার মূল্য ১০০ টাকা ধরলেও এ বাবদ হয় ৪০ কোটি টাকা। গরু ও ছাগলের চামড়া মিলিয়ে এ পুরো টাকা চলে যাচ্ছে সরাসরি গরিবদের হাতে।
অনেকে হাটে গিয়ে কুরবানির পশু কেনার বিড়ম্বনা এড়াতে অনলাইনে কেনাকাটায় স্বাচ্ছন্দ্য পান। গত কয়েক বছর ধরেই উল্লেখযোগ্য হারে অনলাইনে কুরবানির পশু বিক্রি হয়। এবারো ডিজিটাল হাটে বিক্রি হওয়া পশুতে কোনো হাসিল (কর) দিতে হবে না। কয়েক বছর ধরে ই-ক্যাবের তত্ত্বাবধানে ডিজিটালহাট ডটনেট পরিচালিত হলেও এখন থেকে এই হাট সরকারি প্ল্যাটফর্ম হিসেবে এটুআই একশপের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হচ্ছে। এর নতুন ওয়েবসাইট ডিজিটালহাট ডট জিওভি ডট বিডি। এই ডিজিটাল হাট কুরবানির পশু কেনার একটি বড় মাধ্যম। এই হাটের মাধ্যমে শুধু কুরবানির পশু কেনাবেচাই নয়, জবাই, পরিবহনসহ বিভিন্ন সেবা পাওয়া যাচ্ছে। গত বছর এই ডিজিটাল হাটের মাধ্যমে ৮৫০টির বেশি আঞ্চলিক হাট অনলাইনে যুক্ত করা হয়। সেখান থেকে যুক্ত হয় ১০ লাখ কুরবানির পশু।
বাংলাদেশে রপ্তানি খাতে চামড়ার অবস্থান তৃতীয়। কুরবানির ওপর ভর করেই টিকে আছে বিপুল সম্ভাবনার এ খাতটি। বাংলাদেশ থেকে ইতালি, নিউজিল্যান্ড, পোল্যান্ড, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, জার্মানি, কানাডা, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে প্রচুর চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি হয়। মোট চামড়ার ৬০ থেকে ৭০ ভাগই সংগৃহীত হয় কুরবানির ঈদে। এ বাবদ ট্যানারি মালিকরা বিভিন্ন পর্যায়ের পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীদের শত শত কোটি টাকা দাদন দিয়ে থাকেন। সংশ্লিষ্টদের দাবি, কুরবানির সময় চামড়া সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণে ১ হাজার কোটি টাকার ব্যবসা জড়িত। লবণ হলো চামড়া সংরক্ষণের অন্যতম উপাদান। কুরবানি উপলক্ষে লবণের ব্যবসাও চাঙা হয়ে ওঠে।
প্রতি বছর দেশে ২২ লাখ টন পেঁয়াজ, ৫ লাখ টন রসুন আর ৩ লাখ টন আদার চাহিদা থাকে। এর উল্লেখযোগ্য অংশই ব্যবহার হয় কুরবানি ঈদে। গরম মসলার মধ্যে এলাচ, দারচিনি, লবঙ্গ, জিরা, তেজপাতারও উল্লেখযোগ্য অংশ এই ঈদে ব্যবহার হয়। কুরবানির বাজারে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকার লেনদেন হবে মসলাজাতীয় পণ্যের।
কুরবানির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ কামারবাড়ির পণ্য। ছুরি, বঁটি, দা, চাপাতি, কুড়াল, রামদা ছাড়া কুরবানি সম্ভব নয়। সঠিক কোনো পরিসংখ্যান না থাকলেও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, কুরবানিতে এ পণ্যের বাজার ১ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে ৩২ হাজার ৪৫৩টি পরিবারে ১ লাখ ৩৮ হাজার ১৯৩ জন সদস্যের জীবিকা নির্বাহ হয় কামার পেশার মাধ্যমে। এ পেশার মানুষ অপেক্ষায় থাকেন ঈদুল আজহার। রাজধানীর কামারশালাগুলোয় এ সময় ২ থেকে ৫ লাখ টাকার মতো বিক্রির আদেশ আসে।
এদিকে কুরবানির মাংস সংরক্ষণে বছরের যে কোনো সময়ের তুলনায় ফ্রিজ বিক্রির পরিমাণ কয়েকগুণ বেড়েছে। ফ্রিজ ব্যবসায়ীদের দেয়া তথ্যমতে, দেশে বছরে ১৫ লাখ ফ্রিজের চাহিদা আছে। বছরের ৩০ ভাগ ফ্রিজই বিক্রি হয় কুরবানির ঈদে। একইভাবে কুরবানির পশু কেনার পর যে ২-৩ দিন কুরবানিদাতা নিজের কাছে রাখেন এ সময় তাকে রক্ষণাবেক্ষণের কাজে ব্যবহারের জন্য বস্তার চট কেনা হয়, খাওয়ানোর জন্য কেনা হয় খড়, ভুসি ইত্যাদি। এসব কেনার ক্ষেত্রে কয়েক কোটি টাকা হাতবদল হয় ঈদবাজারে- যা দেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করছে।
এফবিসিসিআইয়ের সমীক্ষা অনুযায়ী, ঈদে পরিবহন খাতে অতিরিক্ত প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে সাধারণ মানুষ। এ উৎসবে ভ্রমণ ও বিনোদন বাবদ ব্যয় হয় ৪ হাজার কোটি টাকা। এর বাইরে আরো কয়েকটি খাতের কর্মকাণ্ড অর্থনীতিতে যোগ হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে সাড়ে ২৪ লাখ সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীর সম্ভাব্য বোনাস বাবদ প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা। দেশব্যাপী ৬০ লাখ দোকান কর্মচারীর বোনাস ৪ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। পোশাক ও বস্ত্র খাতের ৭০ লাখ শ্রমিকের সম্ভাব্য বোনাস ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এ অর্থ ঈদ অর্থনীতিতে বাড়তি যোগ হচ্ছে।
প্রিন্ট