শত শত মানুষের চোখের সামনে কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায় ভয়াবহ আগুনে দাউ-দাউ করে জ্বলছিল পান বরজ। আগুনের লেলিহান শিখা ভয়াবহ রূপ ধারণ করে ছোট-বড় ৩৬শ’পান বরজ এক এক করে পুড়ে ছাই হয়ে যায়। ফায়ার সার্ভিসের মোট ১২টি ইফনিট কর্মীরা আগুন নেভাতে কাজ করেন। ৩০ ঘন্টা পার হলে ও বাহাদুরপুর এলাকা জুড়ে পান পোড়াগন্ধ যায়নি। প্রায় ৪শ’ কৃষকের বুক মাটিতে ঠেকেছে। প্রায় ৭০ হাজার পিলি পান পুড়ে কৃষকদের সর্বনাশ হয়েছে। এহেন ঘটনায় এলাকার লোক হতভম্ব হয়ে পরেছে। মুহূর্তেই আগুন ৭ কিলো মিটার এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। পান চাষীদের আর্তনাদ আর চারপাশের মানুষের আহাজারিতে বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ভেড়ামারায় এটাই অবিস্মরণীয় ঘটনা। কৃষি অফিস ক্ষতির পরিমাণ বলেছেন ৩৬ কোটি টাকা।
হঠাৎ পান বরজে আগুন। দিনের আলোয় কৃষকদের চোখের সামনে মুহূর্তের মধ্যে ৪শতাধীক পানবরজ পুড়ে ছাই। পান বেচার টাকায় রুটি-রুজি এই এলাকার মানুষ গুলোর। আগুন লাগাই সর্বনাশ হয়ে গেছে তাদের সোনালী স্বপ্ন। আশার আলো কাঁচের পাত্রের মত কৃষকদের স্বপ্ন ভেঙে খানখান হয়ে গেছে। সাজেদা খাতুন বুক চাপড়িয়ে বললেন কি সর্বনাশ হয়ে গেল আমার। কি খামু। ছেলেমেয়ের লেখাপড়া খরচ কিভাবে আসবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এলাকার বেশ কয়েক জন বলেছেন, এলাকার উঠতি বয়সের যুবকরা পান বরজের মধ্যে গাজা খাই। ফেলে যাওয়া গাজার বিড়ির আগুনে হঠাৎ পান বরজে আগুন ধরে যেতে পারে।
ভয়াবহ আগুন ৬ঘন্টা ধরে জ্বলতে থাকে পান বরজ। এই সময়ের মধ্যে ছোট বড় মিলে মোট ৩৬০০ পান বরজ আগুনে পুড়ে ছাঁই হয়ে যায়। ভেড়ামারা কৃষি অফিসার মাহমুদা সুলতান বলেন, উপজেলার বাহাদুরপুর ইউনিয়নের তিনটি ব্লকে মোট ২০০হেক্টর চলতি মওসুমে পান চাষ করা হয়। বাহাদুরপুর ও আড়কান্দি ব্লকে প্রায় ১শ' হেক্টর আবাদকৃত পান বরজে আগুন ধরে ৭০ হাজার পিলি পান পুড়ে ছাই হয়ে যায়। ক্ষতিগ্রস্ত প্রায় চার হাজার কৃষকের লোকসান গুনতে হচ্ছে প্রায় ৩৬ কোটি টাকার মতো।
উল্লেখ্য,রবিবার ১০ মার্চ বেলা সাড়ে ১১টার সময় ভেড়ামারা উপজেলার বাহাদুরপুর ইউনিয়নের পদ্মার তীর ঘেসে রায়টা পাথর ঘাট সন্নিকটে পুরাতন পাড়া পান চাষী মিলন ও পরে সিরাজের পান বরজে আগুনের সূত্রপাত ঘটে। পান বরজে হঠাৎ করে আগুনের লেলিহান ছড়িয়ে পরে। মাধপপুর, আড়কান্দি,কাজি পাড়া, মালি পাড়া, গোসাই পাড়াসহ মোট সাতটি গ্রামের পান বরজে আগুন ছড়িয়ে পরে। পান বরজ গুলো খুবই কাছা কাছি হওয়ায় আগুনের লেলিহান শিখায় ছড়ি গিয়ে পুড়তে থাকে শুকনো খড়কুট পান বরজ গুলোতে।
ক্ষতিগ্রস্থ পান চাষী মিলন আলী বলেন, আমি তখন বাড়িতে ছিলাম। ইতোমধ্যে হইচই। কিচ্ছু বুঝে উঠার আগেই কালো ধুয়া বিকট শব্দ শুনতে পেয়ে দড়িয়ে গিয়ে দেখি আমার পান বরজে আগুন দাও দাও করে জ্বলছে। এলাকার লোকজন ফায়ার সার্ভিসের ষ্টেশনে খবর দেয়। তারা আসার আগেই আমার চোখের সামনে পান বরজ পুড়ে ছাই হয়ে যায়।
আড়কান্দি গ্রামের পান চাষী আমিনুল ইসলাম জানান,মাঠে পানের বরজে কাজ করছিলাম। এ সময় শুনলাম রায়টা মাঠে পানের বরজে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। মুহূর্তের মধ্যেই বাতাসের গতিতে এক বরজ থেকে আরেক বরজে আগুন ছড়িয়ে পড়ছে। কিচ্ছুক্ষণ পর দেখি দমকা হাওয়ায় আগুনের লেলিহান আড়কান্দি গ্রামের দিকে ধাওয়া করছে। পরে আমার বরজে আগুন ধরে যায়।
ভেড়ামারা উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা মোঃ তোফাজ্জল হোসেন জানান, ভেড়ামারা উপজেলার বাহাদুরপুর ইউনিয়নের রায়টা পাথরঘাট এলাকা, মিটন নগর গ্রাম, আড়কান্দি গ্রাম, মাধবপুর গ্রাম, গোসাই পাড়া গ্রাম ও মালিপাড়া গ্রামের পান বরজ গুলো পুড়ে যায়।
মাধবপুর এলাকার নয়ন নামে এক পান চাষি বলেন, অগ্নিকাণ্ডে আমাদের সব স্বপ্ন পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। সন্তানের মতো করে পানের বরজের যত্ন করেছিলাম। সবকিছু পুড়ে গেছে। আমার দুই বিঘা জমিতে পানের বরজ ছিল। আগুনে পুড়ে ৪ থেকে ৫ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। আমাদের এলাকার কৃষকদের ৯০ ভাগই পান চাষের সাথে জড়িত। সবাই মহাবিপদে পড়ে গেছি। সরকারের কাছে সাহায্য চাচ্ছি আমরা।
কাঁদতে কাঁদতে পান চাষি রবিউল ইসলাম বলেন, এই অঞ্চলের চাষিরা বেশিরভাগই পান চাষ করেন। ৭টি গ্রামের শত শত কৃষকের প্রায় চার থেকে ৫ হাজার বিঘা জমির পানের বরজ পুড়ে গেছে।
অতিরিক্ত কৃষি অফিসার শাহানাজ ফেরদৌসী পান বরজের সঙ্গে ধান,গমসহ অন্যান্য ফসলেরও কমবেশি ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক আমেনা ও জাফর হোসেন বলেন, পানের বরজে পাটকাঠি ও খড় থাকায় আগুন দ্রুত ছড়িয়ে যায়। তাদের প্রায় দুই বিঘা জমির পান বরজ নষ্ট হয়ে গেছে।
মালিপাড়া গ্রামের সাজেদা খাতুন বুক চাপড়িয়ে বললেন আমার সম্বল ছিলো পান বরজ । কি সর্বনাশ হয়ে গেল আমার। আমি এখন কি খামু। ছেলেমেয়ের লেখাপড়া খরচ কিভাবে আসবে।
ভেড়ামারা ফায়ার সার্ভিসের ষ্টেশন অফিসার শরীফুল ইসলাম জানান,পান বরজে ভয়াবহ আগুনের খবর পেয়ে প্রথমে ভেড়ামারার দুটি,পরে কুষ্টিয়ার দুটি, কুমারখালীর দুটি, মিরপুরের দুটি, ঈশ্বরদীর দুটি, ও চুয়াডাঙ্গা ১টি মোট ১২টি ইউনিট আগুন নেভাতে কাজ করে। বেশি রোদ ও হালকা বাতাস হওয়ায় প্রায় ৭ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে আগুন দ্রুত মাঠের পর মাঠ ছড়িয়ে যায়। এ ছাড়া মাঠে পানির উৎস কম থাকায় আগুন নেভাতে চরম বেগ পেতে হয় ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের। তার পর ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা প্রায় ৬ঘন্টার পর ঐকান্তিক নিরলস প্রচেষ্টায় ১০ মার্চ বিকেল সাড়ে ৪টার সময় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত সর্বশেষে কাজ করে ষ্টেশনে ফিরে তারা।
বাহাদুরপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সোহেল রানা পবন বলেন, ভেড়ামারা বাদুরপুর এলাকায় ভয়বহ পান বরজে আগুনের সূত্রপাত শ্রমিকদের অথবা হুমরাচুমরা উঠতি বয়সের যুবকদের ফেলে দেওয়া বিড়ির আগুনের টুকরো থেকে আগুনের সৃষ্টি হতে পারে।
ভেড়ামারা থানার অফিসার্স ইনচার্জ জহুরুল ইসলাম বলেন, আগুন লাগার খবর পেয়ে ঘটনা স্থলে ছুটে যায়। কারণ সম্পর্কে সুনিদির্ষ্ট ভাবে কেউ বলতে পারেনি। থানায় কোন কৃষক তেমন কোন অভিযোগ ও করেনি। অভিয়োগ করলে কঠোর ভাবে পদক্ষেপ নেয়া হবে।
ভেড়ামারা উপজেলা নির্বাহী অফিসার আকাশ কুমার কুন্ডু বলেন, আগুনের পুড়ে যে সব পান চাষী পরিবার ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে তা যাচাই-বাছাই করে বাংলাদেশ সরকার পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
ক্ষতিগ্রস্থ এলাকা সোমবার ১১ মার্চ,পরির্দশন করেন, কুষ্টিয়া- ২ (ভেড়ামারা -মিরপুর) আসনের সংসদ সদস্য আলহাজ্ব কামারুল আরিফিন, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আলহাজ্ব আক্তারুজ্জামান মিঠু, ভেড়ামারা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আকাশ কুমার কুন্ডু, উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান বুলবুল হাসান পিপুল, ভেড়ামারা থানার অফিসার্স ইনচার্জ জহুরুল ইসলাম, উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা শহীদুল্লাহ পরিদর্শন করুন।
যশোর অতিরিক্ত কৃষি পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) দীপক কুমার রায়। উপপরিচালক ড. হায়াত মাহমুদ। জেলা প্রশিক্ষণ অফিসার মোঃ আব্দুল করিম ও ভেড়ামারা কৃষি কর্মকর্তা মাহমুদা সুলতানা।
সম্পাদক ও প্রকাশকঃ মোঃ মুরসিদ আহমেদ সিকদার, মোবাইল : 01728 311111
ঢাকা অফিসঃ হোল্ডিং-১৩, লাইন-৬, রোড- ১২, ব্লক-বি, মিরপুর-১১, ঢাকা-১২১৬
ফরিদপুর অফিসঃ মুজিব সড়ক, ফরিদপুর, ই-মেইলঃ [email protected]
Copyright © August, 2020-2025 @ Daily Somoyer Protyasha