পাবনার চাটমোহরের বিলচলনের বোঁথর গ্রামে বৃহস্পতিবার (১৩ এপ্রিল) সকাল থেকে শুরু হয়েছে তিনদিনব্যাপী ঐহিত্যবাহী চড়ক পূজা ও মেলা। বড়াল নদীর পাড়ে এই ঐতিহ্যবাহী চড়ক পূজা ও মেলা উপলক্ষ্যে এলাকার মানুষের মধ্যে বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখা যাচ্ছে।
এই মেলা দেখতে দেশের বিভিন্ন স্থান ও ভারত থেকেও ভক্তরা এসেছেন। তাঁদের নিরাপত্তা দিতে ও মেলা সুষ্ঠভাবে সম্পন্ন করতে সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছে চড়ক পূজা ও মেলা পরিচালনা কমিটি ও স্থানীয় প্রশাসন।
জানা গেছে, চৈত্র সংক্রান্তির আগের দিন বোঁথড় গ্রামটি হয়ে ওঠে তীর্থক্ষেত্র। তবে কবে থেকে এই পূজা ও মেলা শুরু হয়েছে তার সঠিক ইতিহাস জানা যায়নি। তবে অনেকের ধারণা সিন্ধু সভ্যতা থেকেই এ মেলার প্রচলন। আবার অনেকে বলেন, এই পূজার প্রচলন হয় বান রাজার আমল থেকে। শুদ্র হিন্দু সম্প্রদায়ের মুক্তির বার্তা নিয়ে মহাদেবের আবির্ভাব।
২৭ শে চৈত্র সন্ধ্যার পরে পাঠ ঠাকুরের পাঠে ধুপ দিয়ে এই পূজার অনুষ্ঠান শুরু হয়। এরপর চলে ফুল ভাঙা, কালী নাচ, প্রতিমা আসনে তোলা প্রধান বৃত্তাদের উপবাসসহ ধর্মীয় নানান আনুমানিকতা!
চৈত্র মাসের শেষ দুইদিন ও পহেলা বৈশাখে বসে মেলা। শেষ চৈত্রের গোধুলীলগ্নে চড়ক গাছ মাটিতে পুঁতে ঘোরানো হয়। এর আগে ভক্ত ও পূজারীরা চড়ক গাছে ফুল, দুধ ও চিনি দিয়ে পূজা দেন।
কথিত রয়েছে, সান্যাল বংশের অমূল্য ভু-পতি এবং তার ভাই দানবীর ছিলেন ধর্মপ্রাণ। অমূল্য সান্যাল করতেন কাঠের ব্যবসা, নানা বনাঞ্চল থেকে আনতেন শাল কাঠ।
কিংবদন্তী রয়েছে-একবার নদীপথে চালী বেঁধে ৪০টি শাল কাঠ আনেন তিনি। কিন্তু ওই কাঠ যতো বারই গুনলেন হলো ৪১টি। চালি থেকে এমনিতেই পৃথক হলো একটি কাঠ।
সে রাতেই সান্যাল বাবু স্বপ্ন দেখলেন অতিরিক্ত কাঠ খন্ডটি শিব মূর্তির মতো, যা স্থাপন করার নির্দেশ পেলেন সে সময়ে স্রোতস্বিনী বড়াল নদী পাড়ের বোঁথড় গ্রামের শ্মশানে।
তিনি কাঠ খণ্ড থেকে পৃথক করে বৈদিক মতে শ্রী পাঠ ঢাক তৈরি করে পূজার নির্দেশ পেলেন। সেই সান্যাল বাবুর স্বপ্নে পাওয়া নির্দেশে শত শত বছর ধরে চলছে এ মেলা।
নতুন পুরনো সব জামাইকে আনতে হত ঐতিহ্যবাহী বোঁথড়ের এই মেলার সময়। কী হিন্দু, কী মুসলমান, কী খ্রিস্টান প্রতিটি পরিবারের ছিল একই নিয়ম। আত্মীয় স্বজনে ভরে যেতো মেলার পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলো।
পূজা উপলক্ষে হাজারো ভক্ত বাতাসা ছিটায় মঙ্গলার্থে। ছাত্র-ছাত্রীরা পূজা দেয় ভালো ফলাফলের আশায়। কেউ মেলায় আসা মানুষকে জলপান করায়। কেউ করে আতিথেয়তা। মাথার চুলের জটা কাটা হয়, উপোস করে কেউ কেউ। আরো কতো কী।
এখনো বোঁথড় চড়ক পূজার যাবতীয় আনুষ্ঠানিকতা ঠিক আছে। পূজা ও মেলা উপলক্ষে উৎসব মূখর হয়ে ওঠে বোঁথরসহ পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলো।
বোঁথড়ের চড়ক মেলা দারিদ্র জর্জরিত পশ্চাৎপদ বিলপাড়ের গ্রামীণ মানুষের একঘেঁয়ে নিরানন্দ জীবনে সাময়িকভাবে হলেও আনে কিছুটা বৈচিত্র্যের স্বাদ।
উপজেলা পুজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি সহকারী অধ্যাপক অশোক চক্রবর্তী ও চড়ক পূজা উদযাপন কমিটির সভাপতি বিরেন দাস জানান, এ বছর তিনদিনব্যাপী এই চড়ক পূজানুষ্ঠানের পুরোহিত্য করছেন সৌরেশ চক্রবর্তী ও সত্যেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। হাজারো ভক্ত পূণ্যার্থীদের সমাগম ঘটছে। সাথে রয়েছে দূর দূরন্ত থেকে আসা সন্যাস বাড়িতে ভক্ত বৃন্দদের জন্য প্রসাদের ব্যবস্থা। পূজা ও মেলা সুষ্ঠভাবে সম্পন্ন করার জন্য সবার সহযোগিতা কামনা করেছেন। এ চড়ক পূজা ও মেলা শেষ হবে ১৫ এপ্রিল রোববার।
চাটমোহর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ওসি জালাল উদ্দীন জানান,বোঁথরে চড়ক পুজা ও মেলায় আইনশৃঙ্খলা স্বাভাবিক রাখতে মেলার ৩ দিন পুলিশ মোতায়ন রয়েছে।