দুবাইয়ের স্বর্ণের অন্যতম বাজার নিউ গোল্ড সুক। এ এলাকার নামীদামি কয়েকটি বড় স্বর্ণের দোকানের নামই সাধারণত স্থানীয় দোকানিরা জানেন। পথচলতি মানুষও দোকানগুলোতে থরে থরে সাজানো স্বর্ণ ও অলংকারের দিকে চেয়ে থাকেন। তবে ব্যতিক্রম ৫ নম্বর ভবনের হিন্দ প্লাজার ১৬ নম্বর দোকান ‘আরাভ জুয়েলার্স’। সোনা দেখা না গেলেও দোকানটি নিয়ে ব্যাপক আগ্রহ প্রবাসী বাংলাদেশিদের। বাংলাদেশের তারকাদের দিয়ে উদ্বোধন করে আলোচনায় আসা দোকানটির সামনে অসংখ্য প্রবাসী এসে ছবি তুলছেন।
১৫ মার্চ উদ্বোধন করা দোকানটি নিয়ে দেশেও চলছে নানা আলোচনা-সমালোচনা। দোকানটির মালিক ভারতীয় পাসপোর্টধারী আরাভ খান আসলে বাংলাদেশের রবিউল ইসলাম। যিনি রাজধানীর বনানীতে পুলিশ পরিদর্শক মামুন ইমরান খান হত্যা মামলার এজাহারভুক্ত পলাতক আসামি। আরও ছদ্মনামের মতো তাঁর বিরুদ্ধে রয়েছে আরও কয়েকটি মামলায় পরোয়ানা। তিনি নিজেকে বড় ব্যবসায়ী দাবি করলেও দুবাইয়ে তাঁর পরিচিতরা বলছেন, এর সবই গল্প, ফাঁকি। তাঁরা বলছেন, আলোচিত দোকানটিতে অন্যরাও বিনিয়োগ করেছেন। যেসব ফ্ল্যাটকে নিজের বলে চালাচ্ছেন, সেগুলোও অন্যের। অর্থ ধার করেছেন কয়েকজনের কাছ থেকে। তাঁর সবই যেন ফাঁকি!
দুবাইয়ে গত তিন দিন খোঁজ নিয়ে আরাভ খান ওরফে রবিউল সম্পর্কে জানা গেছে এসব তথ্য। নিউ গোল্ড সুকের প্রধান সড়ক থেকে গলিতে ঢুকলেই চোখে পড়ে আরাভ জুয়েলার্স নামের দোকানটি। কাচে ঘেরা দুই শাটারের দোকানটির শোকেসে বড় আকারের একটি সোনা রঙের ইগল ছাড়া আর কিছু নেই। গতকাল মঙ্গলবার সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত দোকানটি খোলা হয়নি। তবে কয়েকজন প্রবাসী বাংলাদেশি গতকালও দোকানটির সামনে এসেছিলেন। গত রোববার দোকানটি খোলা ছিল। আরাভ খানকেও দেখা গিয়েছিল। তবে সোমবার তিনি আসেননি।
ঢাকঢোল পিটিয়ে উদ্বোধন করা দোকানটির আয়তন মাত্র ৪০০ বর্গফুট। দুবাইয়ে বিভিন্নজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আরাভ এক বছরের জন্য দোকানটি ভাড়া নিয়েছেন। প্রতি বর্গফুটের ভাড়া ৭০ দিরহাম। ভাড়া হিসেবে এক বছরে পরিশোধ করতে হবে ২৮ হাজার দিরহাম; যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৮ লাখ ৬৮ হাজার টাকা। আরাভ খান টাকা নিয়ে আরও চারজনকে দোকানটির ব্যবসায়িক অংশীদার করেছেন। তাঁরা হলেন দোকানের তত্ত্বাবধায়ক উসমান গণি, দুবাইপ্রবাসী কুমিল্লার শাহেদ আহমেদ, ঢাকার দোহারের রাফসান জামি ও শাকিব হোসেন। তাঁরা সবাই মিলে বড় অঙ্কের অর্থ দিয়েছেন আরাভকে।
জানতে চাইলে রাফসান জামি বলেন, ‘বড় অংশের মালিক আরাভ ভাই হলেও আমাদের চারজনকে ওয়ার্কিং পার্টনার করে টাকা নিয়েছেন। দোকানে আমাদেরও বিনিয়োগ রয়েছে। বলেছেন, আমেরিকাসহ অন্যান্য শহরের দোকান শুধু ওনার (আরাভ) নিজের। এ দোকান আমাদের দিয়ে দেবেন।’ কী পরিমাণ বিনিয়োগ আছে, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সাত মাস আগে দুবাই এসেছি। বাড়ি থেকে আমরা সবাই ব্যবসার কথা বলে অনেক টাকা এনেছি।’
তবে রোববার দোকানে অন্য কারও বিনিয়োগ আছে কি না, জানতে চাইলে আরাভ বলেন, ‘নিজের টাকাই তো রাখতে পারি না। অন্যের টাকা দিয়ে কী করব।’
ধার করে সাকিবকে ৫০ হাজার দিরহাম পরিশোধ
জানা গেছে, দোকানের কোনো ধরনের প্রস্তুতি ছাড়াই তড়িঘড়ি করে উদ্বোধন করা হয়। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ থেকে যাঁরা এসেছেন, তাঁদের মধ্যে শুধু জাতীয় দলের ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানকে ৫০ হাজার দিরহাম সম্মানী দেওয়া হয়েছে। হিরো আলমসহ অন্যদের আসার পর টাকা দেওয়ার কথা থাকলেও দেওয়া হয়নি। তাঁরাও পরিস্থিতি বুঝে টাকা না নিয়ে চলে গেছেন। অনুষ্ঠান সমন্বয়ের দায়িত্বে থাকা দোকানের অংশীদার উসমান বলেন, সাকিবকে দেওয়ার পুরো টাকাও ছিল না। অন্য এক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ৫ হাজার দিরহাম ধার করতে হয়েছে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ঘিরে কিছু ভিডিও কনটেন্ট তৈরি করা প্রবাসী এক টেলিভিশন সাংবাদিককেও টাকা পরিশোধ করেননি আরাভ।
বুর্জ খলিফার ফ্ল্যাটের মালিক সৌদি নাগরিক, মারদিফের ফ্ল্যাট ভাড়ার
বুর্জ খলিফার অভিজাত যে ফ্ল্যাটটি আরাভ খান ওরফে রবিউল নিজের বলে দাবি করেছেন, তা একজন সৌদি নাগরিকের। সূত্র বলেছে, মূল মালিকের কাছ থেকে বিক্রির মধ্যস্থতাকারী হিসেবে একটি চুক্তি হয় আরাভ খানের সঙ্গে। ওই চুক্তিনামা তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দিয়ে নিজেকে মালিক দাবি করেন। এ ছাড়া তিনি এক দিন সেখানে অবস্থান করার সুযোগ পেয়ে ভিডিও করেন।
এ ছাড়া আরাভ নিজেকে দুবাইয়ের মারদিফ সিটি সেন্টার এলাকার ১৫ নম্বর স্ট্রিটে ‘আরাভ ভিলা মারদিফ’ নামক দুটি অভিজাত ডুপ্লেক্স ফ্ল্যাটের মালিক বলেও দাবি করেছেন। আসলে এ দুই ফ্ল্যাটেরও মালিক সৌদি আরবের আরেক নাগরিক। আরাভের ঘনিষ্ঠ এক বন্ধু গতকাল গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আরাভ এক বছরের জন্য ফ্ল্যাট দুটি ভাড়া নিয়েছে। আমি এ চুক্তিনামার সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। দুবাইয়ে সবাই ভাড়া নিয়ে বাস করে। কিন্তু সে নিজের বলে দাবি করে।’
অনেকেই টাকা পান আরাভের কাছে
দুবাইয়ের পুরোনো এবং নিউ গোল্ড সুক এলাকায় বাংলাদেশিদের ১৪টি সোনার দোকান আছে। এসব ব্যবসায়ীর প্রায় সবার কাছ থেকে অর্থ ধার নিয়েছেন আরাভ। নিজেকে বড় ব্যবসায়ী পরিচয় দিলেও তাঁর ধারের পরিমাণ ৫০০ দিরহাম থেকে সর্বোচ্চ ৫০ হাজার দিরহাম। এনআরআই জুয়েলার্সের মালিক রাসেল (যাঁর দোকানে ইগল রেখে ছবি তোলা হয়েছে) গণমাধ্যমকে বলেন, ‘পরিচয়ের পর থেকে আমার কাছ থেকে এক বছরে চার-পাঁচবার ধার নিয়েছে। প্রথম প্রথম ৫০০, ১ হাজার দিরহাম ধার নিয়ে ফেরত দিয়েছেন। সম্প্রতি বড় অঙ্কের ধার নিয়েছেন। এখন আর ফোনে তাঁকে পাচ্ছি না। তাঁর আশপাশের লোকজনও ফোন ধরে না। হয়তো আরও অনেকে টাকা পাবেন।’
আরেক দুবাইপ্রবাসী তপন হাওলাদার বলেন, ‘আরাভের সঙ্গে পরিচয় খুব বেশি দিনের নয়। ওর মিষ্টি ব্যবহার আমাকে আকৃষ্ট করেছে। আমিও কিছু ব্যবসার আশায় তাঁর সঙ্গে মিশেছি। কিন্তু সে মাঝেমধ্যে অল্প দিরহাম ধার নিত। কয়েকবার ফেরতও দিয়েছে। তখনই আমার সন্দেহ হয়, বড়লোক হলে ধার লাগবে কেন?’
গাড়ির দাম ১৫ লাখ টাকা, দাবি ৩ কোটি
আরাভ খান ল্যান্ড রোভার একটি গাড়ি ব্যবহার করেন। ২০১২ মডেলের এমন গাড়ি দুবাইয়ে ১৪-১৫ লাখ টাকায় পাওয়া যায়। এ গাড়িতে চড়ে তিনি ফেসবুক লাইভ দিতেন। কেউ এর দাম জানতে চাইলে বলতেন ৩ কোটি টাকা।
অনলাইনে গোল্ডের বাজার
স্বর্ণ কেনাবেচার জন্য বাংলাদেশ থেকে ব্যবসায়ীদের একটি বড় অংশ আসেন দুবাইয়ে। তাঁরা মূলত নিউ গোল্ড সুক এলাকার পাশে ঘর ভাড়া নিয়ে থাকেন। বেশি মুনাফার আশায় তাঁরা সোনার ব্যবসার সঙ্গে জড়িত মানুষের সঙ্গে ওঠাবসা করেন। সূত্র বলেছে, তাঁদের টার্গেট করেই আরাভ খান সোনা বেচাকেনার একটি অনলাইন প্ল্যাটফর্ম করেছেন। তবে এটি এখনো চালু হয়নি। প্রচার করা হয়েছে, এই প্ল্যাটফর্মে সোনা কেনাবেচা করলে বেশি মুনাফা হবে। আসলে এটি হতো প্রতারণার ফাঁদ। কারণ, দুবাইয়ে ব্যবসা করতে হলে কিছু নিয়মকানুন মানতে হয়। কিন্তু এসব না মেনে বিনা পুঁজিতে ব্যবসায়ী বানানোর প্রলোভন প্রতারণার জাল। কয়েকজন প্রবাসী জানান, মানুষকে প্রতারণার জালে ফেলার আগেই তাঁর (আরাভ) মুখোশ উন্মোচন হয়ে গেছে।
আরাভ রিয়েল এস্টেট ও ট্রাভেল এজেন্সি
আরাভের ব্যবসা দেখাশোনা করেন এমন একজন জানান, তাঁর আরও কিছু ব্যবসা আছে। এর মধ্যে আরাভ রিয়েল এস্টেট ও আরাভ ট্যুর অ্যান্ড ট্রাভেল এজেন্সি। এ ছাড়া এক বন্ধুর নামে শারজায়ও কিছু ব্যবসা থাকার কথা বলছেন কেউ কেউ। সূত্র বলছে, এসব ব্যবসার নামে অংশীদারত্বের কথা বলে মানুষের কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন তিনি। বাংলাদেশি কয়েকজন ট্রাভেল এজেন্সি ব্যবসায়ী আরাভের কাছে দিরহাম পাবেন বলে জানা গেছে।
এসব বিষয়ে আরাভ খানের কথা বলার সময় নির্ধারিত ছিল সোমবার সকালে তাঁর দোকানে। কিন্তু সারা দিন আরাভ জুয়েলার্সের সামনে অপেক্ষা করেও তাঁর দেখা পাওয়া যায়নি। ফোন করলেও সাড়া দেননি।
সম্পাদক ও প্রকাশকঃ মোঃ মুরসিদ আহমেদ সিকদার, মোবাইল : 01728 311111
ঢাকা অফিসঃ হোল্ডিং-১৩, লাইন-৬, রোড- ১২, ব্লক-বি, মিরপুর-১১, ঢাকা-১২১৬
ফরিদপুর অফিসঃ মুজিব সড়ক, ফরিদপুর, ই-মেইলঃ [email protected]
Copyright © August, 2020-2025 @ Daily Somoyer Protyasha