রাশিদুল ইসলাম রাশেদঃ
আজ ৫ মে লালপুরের ইতিহাসের অন্যতম শোকাবহ ও স্মরণীয় নর্থ বেঙ্গল সুগার মিলস লিমিটেড (নবেসুমি) এর গণহত্যা ও শহীদ সাগর দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে নাটোরের লালপুরে গোপালপুর নর্থ বেঙ্গল সুগার মিলের অর্ধশত কর্মকর্তা, কর্মচারী ও স্থানীয় মুক্তিকামী মানুষকে পাক হানাদার বাহিনী সুগার মিলের অদূরে পুকুর পাড়ে সিড়ির উপর দাঁড় করিয়ে ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করে।
.
মুক্তিকামী সে সকল বীর শহীদদের রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল পুকুরের পানি। এরপর থেকে এর নামকরণ করা হয়েছে শহীদ সাগর। জনশ্রুতি আছে স্বাধীনতার পরেও অনেক বছর পর্যন্ত এ পুকুরের পানি রক্তে রঞ্জিত ছিল। সিড়ির যেসব জায়গায় গুলিবিদ্ধ হয়েছিল, সেসব জায়গায় প্রতিকী অর্থে লাল রং দিয়ে রাখা হয়েছে। সেখানে পা দিলে এখনো গা ছম ছম করে ওঠে। মনের অজান্তেই মন গেয়ে উঠে স্বপ্না রায়ের কালজয়ী সেই গান "এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলার স্বাধীনতা আনলে যাঁরা......।"
.
দিনটি উপলক্ষে প্রতি বছরের ন্যায় এ বছরও মিল কর্তৃপক্ষ আজ সকাল সাড়ে ১০ টার দিকে শহীদদের স্মরণে শহীদ সাগর চত্তরে কুরআন তেলোয়াত, দোয়া ও আলোচনা সভার আয়োজন করে। নর্থ বেঙ্গল সুগার মিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ ফরিদ হোসেন ভূঁইয়া টুটুল এর সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখেন লালপুর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভুমি) আজিজুল কবির, সুগার মিল শহীদ পরিবার ফোরাম ৭১ এর সভাপতি ফরহাদুজ্জামান রুবেল, সিবিএ সভাপতি আশরাফুজ্জামান উজ্জল, সাধারণ সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন পিন্টু, সাংগঠনিক সম্পাদক মমিনুল ইসলাম মানিক, শহীদ পরিবারের সদস্য শাহিন আল হাসার তালুকদার, আখ চাষি নেতা আনছার আলী দুলাল, বীর মুক্তিয়োদ্ধা সামসুল ইসলাম। বক্তারা বলেন, দিবসটি লালপুরের মানুষ পালন করলেও এখনো রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। তাই তারা এই দিনটিকে নর্থ বেঙ্গল সুগার মিলস লিমিটেড গণহত্যা ও শহীদ সাগর দিবস হিসেবে স্বীকৃতির জোর দাবি জানিয়েছেন।
.
লালপুরের মুক্তিযুদ্ধের স্মরণীয় দিনটি নিয়ে সোমবার (৫ মে, ২০২৫) কথা হয় বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ নাঈম উদ্দিন (৭০) সাথে, তিনি সময়ের প্রত্যাশাকে বলেন - ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় সারা দেশের শিল্প কারখানা প্রায় বন্ধ ছিল। কিন্তু নাটোরের পাক সেনাদের মেজর শেরওয়ান খান এসে নর্থ বেঙ্গল সুগার মিলের কর্মকর্তা কর্মচারীদের কাজ চালিয়ে যেতে বলেছিলেন। তাদের কোন ক্ষতি করা হবে না এমন প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু তারা সেই প্রতিশ্রুতি রাখেননি। ৫ মে সকালে গোপালপুর বাজারে হানাদার বাহিনীর গোলাগুলিতে অনেকে শহীদ হন। এরপর তারা সুগার মিলের কর্মকর্তা কর্মচারীদের শহীদ সাগরের পাড়ে দাঁড় করিয়ে গণহত্যা চালায়।
.
সেদিনের সেই গণহত্যায় সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়াদের একজন ছিলেন মিলের পাওয়ার হাউসে এসবিএ পদে কর্মরত খন্দকার জালাল আহম্মেদ। মৃত্যুর পূর্বে তিনি একাধিক সাক্ষাৎকারে ৫ মে, ১৯৭১ সালের কথা বলে গেছেন। তিনি সেদিনের বর্ণনায় বলেন, 'গোপালপুর বাজারে গোলাগুলি হলেও পাক মেজরের আশ্বাসে বিশ্বাস করে তারা মিলে কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু সকাল ১১টার দিকে পাক সেনারা মিলের সবাইকে নিয়ে এসে গণনা করে বাঙালি মেসের সামনে মাটিতে উপুড় করে শুয়ে দেয়। কেউ মাথা উঁচু করলে রাইফেলের বাট দিয়ে আঘাত করা হচ্ছিল। এ সময় মিলের হিসাবরক্ষক আব্দুল মান্নান তার গলায় ঝুলিয়ে রাখা কুরআন পড়ার চেষ্টা করলে একজন পাক সেনা তেড়ে আসে। কোরআন পড়তে দেখে তাকে ছেড়ে দেন। কিন্তু মিলের বাকিদের ছেড়ে তিনি যাননি। এরপর একজন সেনা চিৎকার করে জিজ্ঞাসা করল "মেজর আসলামকে কে হত্যা করেছে?"
.
তখন সবাই বুঝতে পারল স্বাধীনতার প্রথম প্রহরে ৩০ মার্চ, ১৯৭১ ময়নার আম্রকাননে সম্মুখ যুদ্ধে পাকিস্তানি ২৫ নং রেজিমেন্ট ধ্বংস হয়। সে সময় মুক্তিযোদ্ধারা মিলের ওয়াগণ দিয়ে রেলগেটে পাক সেনাদের প্রতিরোধ করেছিলেন, মেজর আসলামকে ধরে এনে হত্যা করেছিলেন। সেই রাগে তারা সুগার মিলকে লক্ষ্য বানিয়েছে। এ সময় মিলের তৎকালীন মহাব্যবস্থাপক লেফটেন্যান্ট এম এ আজিজ বলেন, "সুগার মিলের কেউ মেজর আসলামকে হত্যা করেনি।" এরপর জিএম লে.এম এ আজিম সহ সকলকে পুকুর পাড়ে দাঁড় করিয়ে বৃষ্টির মত গুলি করে হত্যা করা হয়। যখন তার জ্ঞান ফিরে দেখেন চারদিকে লাশের স্তুপ পড়ে আছে। তাকে মৃত ভেবে পাক সেনারা ফেলে গেছে। লালপুর ভূমি অফিসের তৎকালীন কর্মচারী মেহমান আলীর সহায়তায় সেখান থেকে আহতাবস্থায় অনেক কষ্টে এক আত্মীয়ের বাসায় পৌছান তিনি।
.
মিলের জিএম লে. এম এ আজিমের নামানুসারে ১৯৭৩ সালের ১ ফেব্রুয়ারি গোপালপুর রেল স্টেশনের নামকরণ করা হয় আজিমনগর। শহীদ সাগরের পাশে শহীদ আজিমসহ ৪২ জনের নাম খোদাই করে একটি স্মৃতি স্তম্ভ স্থাপন করা হয়েছে। ১৯৭৩ সালের ৫ মে শহীদ লে. এম এ আজিমের স্ত্রী শামসুন্নাহার আজিম এটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। শহীদদের স্মৃতি ধরে রাখতে এর পাশেই ২০০০ সালের ৫ মে একটি জাদুঘর উদ্বোধন করা হয়েছে। জাদুঘরের পরিদর্শন বইয়ে শামসুন্নাহার আজিম লিখেছেন, "স্বাধীনতার জন্য নর্থ বেঙ্গল সুগার মিলের যে অবদান, বুকচিরে এক পুকুর রক্তদানের স্বীকৃতি এই জাদুঘরের মাধ্যমে দেওয়া হল। এর শুভ উদ্বোধন করতে পেরে আজ আমি গর্বিত।"
.
আরেক শহীদের সন্তান কৃষিবিদ আবুল খায়ের পরিদর্শন বইয়ে লিখেছেন, "শহীদ সাগরে এসে আম্মা যখন জানতে চাইলেন, কবর কোথায় দেওয়া হয়েছে। উপস্থিত কারো মুখে কোন কথা ছিল না। আব্বা, তোমার কবর সারা দেশের মাটিতে আছে....।"
'শহীদ সাগরের কাছে এসে তোমাকে খুঁজে পাইনি। তুমি বেঁচে থাকতে এখানেই আমার আনন্দের দিনগুলো কেটেছে। সব আছে, তুমি নেই। এখন আমার সব বিষাদ লাগে...।' শহীদ স্মৃতি জাদুঘরের পরিদর্শন বইয়ে এভাবেই অনুভূতি প্রকাশ করেছেন এক শহীদের স্ত্রী শামসুন্নাহার হাশিম।
.
এখনো ৫ মে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শহীদদের স্বজনরা ছুটে আসেন এই শহীদ সাগর পাড়ে। চাবি নিয়ে শহীদ সাগর ও জাদুঘরের এক নম্বর ফটকটি খুলে দেওয়ার জন্য অপেক্ষা করেন একজন প্রহরী। ছুটির দিন ছাড়া যেকোনো দিন দর্শনার্থীরা ঘুরে দেখতে পারেন শহীদের স্মৃতি বিজড়িত শহীদ সাগর, জাদুঘর ও মুক্তিযুদ্ধে সুগার মিলের ঐতিহাসিক স্থান সমূহ। হয়তো কিছু সময় নির্বাক হয়ে মনের মাঝে ভেসে উঠবে বীর শহীদদের বীরত্বগাথা আত্মত্যাগ।
সম্পাদক ও প্রকাশক: এ. এস.এম
মুরসিদ, মোবাইল: 01728 311111
ঢাকা অফিসঃ হোল্ডিং-১৩, লাইন-৬, রোড- ১২, ব্লক-বি, মিরপুর-১১, ঢাকা-১২১৬।