আলিফ হোসেনঃ
রাজশাহী জেলায় এবার আলুর বাম্পার ফলন হয়েছে। এতে বাজারে আলুর দাম নেই। অধিকাংশক্ষেত্রে এখন আলু বেচে কৃষকের জমি ইজারার খরচই উঠছে না। কৃষক আলু রেখে দিচ্ছেন হিমাগারে। কিন্তু সেখানেও ভর করেছে সিন্ডিকেট। অনেক আগেই কৃষক বুকিং দেওয়ার পরও হিমাগারে আলু রাখতে পারছেন না। দলীয় প্রভাব খাটিয়ে সিন্ডিকেট জোর করে আলু হিমাগারে ঢোকাচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। ফলে অসহায় অনেক কৃষকের আলু জমিতেই পড়ে আছে।
এদিকে প্রায় প্রতিটি কোল্ড স্টোর চত্ত্বরে মধ্যস্বত্ত্বভোগী ও মৌসুমি ফড়িয়া আলু ব্যবসায়ীদের তৎপরতা দেখা গেছে। কোল্ড স্টোরেজের একশ্রেণীর কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশে সিন্ডিকেট করে কম দামে আলু কিনে স্টোর জাত করছে।
রাজশাহীর তানোর উপজেলার কৃষ্ণপুর গ্রামের আলুচাষি রফিকুল ইসলাম জানান, ফেব্রুয়ারির শেষদিক থেকে আলু তোলা শুরু হয়েছে। প্রথম দিকে জমিতে আলুর কেজি ছিল ১২ থেকে ১৩ টাকা। এখন তা ৯ টাকাতে নেমে এসেছে। তার বিঘাপ্রতি জমিতে গড় ফলন হয়েছে ৫৫ বস্তা। সে হিসেবে এক বিঘায় আলুর ফলন প্রায় ৬৯ মণ। জমিতে আলু বিক্রি হচ্ছে ৯ টাকা কেজি দরে। এক বিঘা জমির আলু বিক্রি করলে পাওয়া যাবে ২৪ হাজার ৮৪০ টাকা। অথচ কৃষ্ণপুর এলাকায় তার প্রতিবিঘা জমি ইজারা নেওয়া আছে ২৭ হাজার টাকায়।
রফিকুল ইসলাম জানান, তানোরে আলুচাষের জমি ইজারা নিতে হয় ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা বিঘায়। এছাড়া প্রতি বিঘা জমিতে আলু চাষে খরচ হয় আরও ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা। এখন আলু বিক্রি করলে এই টাকার পুরোটিই লোকসানের খাতায় যোগ হবে। এ অবস্থায় কৃষকেরা হিমাগারে আলু সংরক্ষণের চেষ্টা করছেন, কিন্তু সেখানেও জায়গা হচ্ছে না। অনেক কৃষক আগাম বুকিং দেওয়ার পরও হিমাগারে তাদের আলু নেওয়া হচ্ছে না।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের বিভাগীয় কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, চলতি মৌসুমে উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায় ৩ লাখ ৬৫ হাজার হেক্টর জমিতে আলুর আবাদ হয়েছে। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ৯৮ লাখ ৬৫ হাজার টন। কিন্তু সংরক্ষণের জন্য ২২১টি হিমাগারের ধারণক্ষমতা মাত্র ২৩ লাখ ৭৫ হাজার টন, যা উৎপাদিত আলুর মাত্র ২৩ শতাংশ। ফলে বাকি ৭৫ লাখ ২৩ হাজার টন আলু কৃষকরা বাড়িতে সংরক্ষণ বা বাজারে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। বিপুল পরিমাণ আলু বিক্রি করার কারণে দাম কমে গেছে। অনেক জায়গায় ক্রেতাও মিলছে না।
রাজশাহীর তানোরের পাঁচন্দর ইউনিয়নের (ইউপি) চিমনা গ্রামের এক আলুচাষি জানান, তার ৪০ একর জমি থেকে প্রায় ৭ হাজার বস্তা আলু উৎপাদন হয়েছে। তানোরের আড়াদীঘি এলাকায় অবস্থিত রহমান কোল্ড স্টোরেজের ইউনিট-২ এ আলু রাখার জন্য আগাম বুকিং দেওয়া ছিল। এখন অর্ধেক আলু নেওয়ার পর হিমাগারটি আর আলু নিচ্ছে না। পাঁচদিন আগে আলু তোলার পর এখন জমিতেই বস্তা করে ফেলে রাখা হয়েছে। ওই কৃষকের অভিযোগ, দলীয় প্রভাব খাটিয়ে একটি সিন্ডিকেট বুকিং ছাড়াই জোর করে আলু হিমাগারে দিচ্ছে। আলু রাখার সুযোগ করে দেওয়ার বিপরীতে সিন্ডিকেটটি কৃষকের কাছ থেকে মোটা টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। নিজের আলু রাখা থেকে বঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কায় ওই কৃষক নিজের নাম প্রকাশ করতে চাননি।
তানোরের আলু চাষি আলহাজ্ব সালাউদ্দিন সরদার বলেন,কালীগঞ্জ হাট তামান্না কোল্ড স্টোরেজে তিনি আগাম ৫ হাজার বস্তা বুকিং দিয়েছিলেন।কিন্ত্ত এক হাজার বস্তা আলু নেয়ার পর বাকি ৪ হাজার বস্তা আলু কোল্ড স্টোর নিচ্ছেন না।
তানোরের চাঁন্দুড়িয়া ইউপির আলু চাষি আইয়ুব আলী চার হাজার বস্তা আলু সংরক্ষণের জন্য মাসিন্দা আল-মদিনা সীড কোল্ড স্টোরের ম্যানেজার মাহাবুর রহমানের সঙ্গে চুক্তি করেন(বুকিং দেন)। এবং সেই পরিমাণ আলু চাষ করেন। আল-মদিনার সঙ্গে চুক্তি করার কারণে তিনি অন্য কোথাও আলু সংরক্ষণ করেননি।কিন্ত্ত আইয়ুব আলী জমি থেকে আলু উত্তোলনের পর সংরক্ষণের জন্য আল-মদিনা কোল্ড স্টোরেজে গেলে তার কাছে থেকে মাত্র ৫০০ বস্তা আলু নেয়া হয়। বাকি আলু সংরক্ষণের জন্য গেলে স্টোরে জায়গা নাই, আর কোনো আলু নেয়া যাবে না বলে ম্যানেজার তাকে ফিরিয়ে দেন।
এবিষয়ে রহমান কোল্ড স্টোরেজ ইউনিট-২ এর ব্যবস্থাপক সৈয়দ আবদুল মুনিম কাজল বলেন, সিন্ডিকেট বলে আসলে কিছু নেই। তবে দলীয় প্রভাবে কেউ এলে আগাম বুকিং ছাড়া হয়তো ২০ বস্তা বা ৫০ বস্তা নেওয়া যায়। এর বাইরে তো বেশি নেওয়ার সুযোগ নেই। আগাম বুকিং নিয়েও অনেক কৃষকের আলু না নেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, আলুর প্রচুর ফলন হয়েছে। যারা আগাম টাকা দিয়ে পেইড বুকিং দিয়েছে, তাদের ফেরানোর সুযোগ নেই। সাধারণ বুকিং সব নেওয়া যাচ্ছে না।
তিনি বলেন, কোল্ড স্টোরেজের সংখ্যা কম। ক্যাপাসিটিও কম। আমার এখানে যেমন সাড়ে ৩ লাখ বস্তা আলু নিতে পারব, এখনই ৩ লাখ ১০ হাজার বস্তা ঢুকে গেছে। কিন্তু মাঠে মাঠে এখনও প্রচুর আলু আছে। তারপরও এলাকায় যে কিছু কোল্ড স্টোরেজ হয়েছে তার জন্য আলুর দাম ৯ থেকে ১০ টাকা আছে। তা না হলে তো কেজিপ্রতি দাম হতো ১ টাকা।
মোহনপুর উপজেলার জাহানাবাদ এলাকার আলুচাষি জাহিদুল করিম বলেন, আমরা কৃষক সবদিকেই ক্ষতিগ্রস্ত। আল্লাহ এবার ফলন দিয়েছে, কিন্তু লাভ করতে পারছি না। কোল্ড স্টোরেজে জায়গা পাচ্ছি না। আবার গতবছর কেজিপ্রতি কোল্ড স্টোরেজ ভাড়া ছিল ৪ টাকা। এবার তা হিমাগার মালিকপক্ষ ৮ টাকা করে। পরে অবশ্য সরকার ৫ টাকা ৭৫ পয়সা করেছে। তারপরও দাম না পেলে কৃষকের লাভ হবে না। এবারের ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা কঠিন।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের রাজশাহী বিভাগের অতিরিক্ত পরিচালক ড. মোতালেব হোসেন জানান, এ বছর আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় আলুর উৎপাদন ভালো হয়েছে। তবে সংরক্ষণের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকায় বাজারে সরবরাহ বেড়ে গেছে। ফলে দাম কিছুটা কম।
সম্পাদক ও প্রকাশক: এ. এস.এম মুরসিদ (লিটু সিকদার) মোবাইল: 01728 311111