আলিফ হোসেনঃ
রাজশাহীর তানোরে শুরু হয়েছে আলু তোলার ধুম। তবে হিমাগার সিন্ডিকেট চক্রের তৎপরতায় শুরুতেই আলুর দামে ধস নেমেছে। এবার আলুর দাম একেবারেই কম। জমিতে বিক্রি হচ্ছে ১০ থেকে ১২ টাকা কেজি দরে। কৃষকরা বলছেন, গত এক দশকে আলু দাম এতোটা কম হয়নি। ফলে উৎপাদিত বিপুল পরিমাণ আলু নিয়ে চরম বিপাকে পড়েছে উপজেলার আলু চাষিরা। ক্রেতা না থাকায় কৃষকরা না পারছে জমি থেকে বিক্রি করতে আবার বুকিং না থাকায় হিমাগারেও রাখতে পারছে না। কৃষকদের আরও অভিযোগ আলুর অস্বাভাবিক দরপতনের পেছনে হিমাগার ও আলু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের হাত রয়েছে। হিমাগার মালিকদের সঙ্গে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট যোগসাজশ করে বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে।
ভুক্তভোগী কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত বছর প্রতি কেজি আলু সংরক্ষণে হিমাগার ভাড়া ছিল ৪ টাকা। এবার এক লাফে সংরক্ষণ ভাড়া বাড়িয়ে আট টাকা করা হয়েছে। হিমাগার মালিক ও ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট কৌশল করে হিমাগারের অগ্রিম বুকিং সম্পন্ন করে রেখেছে। এ বছর অধিকাংশ সাধারণ কৃষক আলু রাখার জন্য হিমাগারে কোনো বুকিং সংগ্রহ করতে পারেনি। এখন জমি থেকে আলু তুলে সাধারণ কৃষক না পারছে হিমাগারে দিতে না পারছে বাড়িতে রাখতে। ফলে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট পানির দরে আলু কিনে নিচ্ছে জমিতে। অসহায় কৃষকরা বাধ্য হয়ে কেজিতে ১০ থেকে ১২ টাকায় আলু বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে।
ভুক্তভোগী আলু চাষিরা আরও বলছেন এবার সাধারণ কৃষকরা হিমাগার মালিক ও ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে। ফলে উপজেলার হাজারও আলু চাষি বিপুল আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন। আলু বিক্রি করে উৎপাদন খরচের অর্ধেকও না উঠায় ব্যাংক ও মহাজনী ঋণ পরিশোধ নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন।
জানা গেছে, একদিকে আলুর ভালো দাম না পেয়ে হতাশ কৃষকরা, অন্যদিকে হিমাগারে আলু সংরক্ষণ নিয়েও নানা বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে তাদের। কৃষকদের আন্দোলনের মুখে হিমাগারে আলু রাখার ভাড়া প্রতি কেজি সর্বোচ্চ ৬ টাকা ৭৫ পয়সা নির্ধারণ করে দিয়েছে সরকার। এতে কিছুটা স্বস্তি পেলেও আলু সংরক্ষণের কার্ড (অনুমতিপত্র) চাহিদামতো পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ কৃষকদের। কৃষকদের অভিযোগ, এখন অধিকাংশ হিমাগারে আলু রাখছেন ব্যবসায়ীরা। আবার কার্ড পাওয়ার পরও হিমাগার গেটে আলু নিয়ে কৃষকদের অপেক্ষা করতে হচ্ছে দিনের পর দিন। অথচ ব্যবসায়ীদের ট্রাক ট্রাক আলু ঢোকানো হচ্ছে হিমাগারগুলোতে। অধিকাংশ হিমাগারের তিনভাগ জায়গা এখানো ফাঁকা থাকলেও তারা কৃষকের আলু নিচ্ছেন না,জায়গা সংকটের কথা বলে তাদের ফিরিয়ে দিয়ে ব্যবসায়ীদের কাছে থেকে আলু নিচ্ছেন।
অথচ সরকারী নীতিমালা অনুযায়ী ৬০ শতাংশ কৃষক এবং ৪০ শতাংশ ব্যবসায়ীদের আলু হিমাগারে সংরক্ষণের কথা।কিন্ত্ত তানোরের হিমাগার কর্তৃপক্ষ এসব নিয়ম মানছেন না বলে অভিযোগ রয়েছে। এদিকে হিমাগার কর্তৃপক্ষের দাবি, হিমাগারে রাখা আলুতে লাভ বেশি হওয়ায় এবার কৃষকরা বীজের পাশাপাশি বিক্রির উদ্দেশ্যেও আলু সংরক্ষণে ঝুঁকেছেন। ফলে আলু সংরক্ষণে হিমাগারে চাপ বেড়েছে, যা সামাল দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। দিনে যেখানে হিমাগারে ১০ হাজার বস্তা আলু নেওয়া সম্ভব, সেখানে কৃষকরা নিয়ে আসছেন ২০ থেকে ২৫ হাজার বস্তারও বেশি। ফলে হিমাগার গেটে যানজট তৈরি হচ্ছে।
উপজেলার আলু চাষি শরিফুল ইসলাম বলেন, এবার আবাদ মৌসুমে বীজ আলুর দাম দ্বিগুণ হওয়ায় এক বিঘা জমিতে আলু আবাদে ব্যয় হয়েছে ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকা। এক বিঘা জমিতে এবার আমার আলু হয়েছে ৪ হাজার ৪৫০ কেজি। প্রতি কেজি ১০ টাকা দরে বিক্রি করে পেয়েছি ৪৫ হাজার ৫০০ টাকা। প্রতি বিঘায় এবার আমার ক্ষতি দাঁড়াচ্ছে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা। ঋণ পরিশোধ নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছি। মোহনপুর গ্রামের আলু চাষি মাইনুল ইসলাম অভিযোগে বলেন, হিমাগার মালিকদের সঙ্গে যোগসাজশ করে আলু মজুতদার সিন্ডিকেট হিমাগারের অগ্রিম বুকিং আগেই নিয়ে রেখেছে।ফলে সাধারণ আলু চাষিরা এবার হিমাগারে কোনো বুকিং পায়নি। আমরা গত কয়েক মাস ধরে বুকিং পেতে রাজশাহী জেলা প্রশাসক ও বিভাগীয় কমিশনারের কাছে অভিযোগ দিয়েছি, মানববন্ধন করেছি, কিন্তু প্রশাসন কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।
এবিষয়ে রাজশাহী হিমাগার মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ফজলুর রহমান বলেন, হিমাগারের ভাড়া কেন্দ্রীয়ভাবে বাড়ানো হয়েছে। ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের সঙ্গে যোগসাজশের অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেন, হিমাগারে বুকিং শুরু হয় আবাদ শুরুর অনেক আগে। অনেক ক্ষেত্রে এক বছর আগেই বুকিং হয়ে যায়। এখানে সিন্ডিকেটের কিছু নেই।
এবিষয়ে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সাইফুল্লাহ আহমেদ বলেন, গত বছর আলুর ভালো দাম পাওয়ায় অনেক কৃষক আলু চাষ বাড়িয়েছে। এ কারণে গত বছরের চেয়ে এ বছর বেশী জমিতে আলুর চাষ হয়েছে। এখন চলছে আলু তোলার মৌসুম। তিনি বলেন, এবার আলু চাষের লক্ষমাত্রা ধরা হয়েছিল ১৩ হাজার ১১৫ হেক্টর।কিন্তু চাষ হয়েছে ১৩ হাজার ৩৮৫ হেক্টর জমিতে। উৎপাদন লক্ষমাত্রা ধরা হয়েছে প্রায় ৪ লাখ ২৮ হাজার ৩২০ মেট্রিক টন।
সম্পাদক ও প্রকাশক: এ. এস.এম মুরসিদ (লিটু সিকদার) মোবাইল: 01728 311111