সময়ের প্রত্যাশা ডেস্কঃ
একসময় সবচেয়ে চৌকস কর্মকর্তাকে জেলা প্রশাসক বা ডিসি করা হতো। নিজের উপস্থিত বুদ্ধি দিয়ে একটা জেলাকে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো গুণী কর্মকর্তাকে খুঁজে বের করা হতো এ পদের জন্য। কালপরিক্রমায় উন্নত যোগাযোগের কারণে ঢাকার সঙ্গে জেলাগুলোর দূরত্ব কমে যায়। প্রশাসনিক কেন্দ্রবিন্দু সচিবালয় থেকেই এখন দেওয়া হয় সব নির্দেশনা। এখন ডিসিরা শুধু সচিবালয়ের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করেন। এই পালাবদলে ডিসির গুরুত্ব কমলেও বেড়েছে নির্বাচনে।
ভোটের মাঠপ্রশাসন সাজান ডিসিরা। জাতীয় নির্বাচনে সাধারণত রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করেন। এ দায়িত্ব পাওয়ার পর তারা সহকারী রিটার্নিং অফিসার, প্রিসাইডিং অফিসার, সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার এবং পোলিং অফিসার নিয়োগ দেন। নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলার অংশ দেখেন জেলা পুলিশ সুপার বা এসপি।
বহুল আলোচিত ও রাতের ভোট হিসেবে খ্যাত একাদশ সংসদ নির্বাচনে রিটার্নিং কর্মকর্তাদের দায়িত্ব পালনকারী তৎকালীন ৩৩ ডিসিকে ওএসডি করা হয়েছে গত বুধবার। এর আগেও একই কারণে ১২ কর্মকর্তাকে ওএসডি করা হয়েছিল। সব মিলিয়ে ২০১৮ সালে রাতের ভোটে দায়িত্ব পালনকারী ৪৫ জন ডিসিকে এ পর্যন্ত ওএসডি করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে বাকি ১৯ ডিসিকেও করা হবে। এসব কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোর একটা দূরবর্তী প্রক্রিয়া আগে থেকেই ছিল। কিন্তু সেটা যে ওএসডি করার পরদিনই অর্থাৎ গতকাল বৃহস্পতিবারই তাদের মধ্যে একটা অংশকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হবে, সেটা অনেকেই ধারণা করতে পারেননি। এতে সরকারের কঠোর মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে।
এদিকে আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের বিতর্কিত নির্বাচনে দায়িত্বে থাকা ২২ ডিসিকে গতকাল বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠিয়েছে সরকার। তারা বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগে সচিব এবং অতিরিক্ত সচিব পদমর্যাদায় দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের আলাদা আলাদা প্রজ্ঞাপনে গতকাল এই সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়। এ ছাড়া জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের বিপক্ষে অবস্থান নেওয়ার কারণে শিল্প মন্ত্রণালয়ের সচিব জাকিয়া সুলতানাকে বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হয়েছে। জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের বিপক্ষে অবস্থান নেওয়া এবং বর্তমান সরকারে বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচারণা করার অভিযোগে যুগ্ম সচিব ধনঞ্জয় দাসকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।
ডিসিরা কি এই প্রথম শাস্তি পাচ্ছেন প্রশ্ন করা হয়েছিল অবসরে যাওয়া এক সচিবের কাছে। তিনি রেফারেন্স দিয়ে বললেন, বাধ্যতামূলক অবসর এই প্রথম হলেও, শাস্তি প্রথম না। এই প্রক্রিয়া ২০০৯ থেকে ২০২৪ সালেও অনুসরণ করেছে সরকার। যারা ২০১৮ সালে রাতের ভোট আয়োজন করেছিলেন অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মাধ্যমে তাদের সম্পদ যাচাই-বাছাই করার একটা প্রক্রিয়া রয়েছে। জনপ্রশাসনের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, রাতের ভোটের পর ২০১৩ এবং ২০২৪ সালের ভোট আয়োজনকারীদেরও ধরা হবে। তদারকির মধ্যে রয়েছেন বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ পালনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারাও। বাদ যাবেন না ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী বা উপমন্ত্রীদের একান্ত সচিবরা (পিএস)। ২০১৮ সালের মন্ত্রীদের পিএস নিয়োগ দিয়েছিল তখনকার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। আগে মন্ত্রীরা তাদের পছন্দে পিএস নিয়োগ দিতে পারলেও ওই বছর তা বাছাই করেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কয়েকজন যুগ্ম সচিব ও উপসচিব পদমর্যাদার একটি চক্র। এ কারণে তিন মেয়াদের মন্ত্রীদের পিএসরাও ওএসডি হওয়ার তালিকায় রয়েছেন।
সরকারের মন্ত্রীরা দায়িত্ব গ্রহণের পর একজন চৌকস কর্মকর্তাকে তাদের পিএস করার জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিবকে অনুরোধ করতেন। অথবা তারা তাদের পছন্দের কর্মকর্তাকে পিএস নিয়োগ দেওয়ার জন্য আধা সরকারিপত্র দিতেন। ২০১৮ সালে মন্ত্রীদের পিএস হিসেবে কর্মকর্তা বাছাইয়ের সুযোগ কেড়ে নেওয়া হয়। বেসরকারি ব্যক্তিদের মধ্য থেকে নিয়োগের সুযোগ থাকলেও কোনো কোনো মন্ত্রী তাদের সহকারী একান্ত সচিবও (এপিএস) নিয়োগ করতেন ক্যাডার কর্মকর্তাদের।
জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ফিরোজ মিয়া এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘১৯৯৬ সালের পর থেকেই মন্ত্রীদের পিএস ও জেলা প্রশাসকরা তোপের মুখে রয়েছেন। ধারাবাহিকভাবে তাদের সঙ্গে একই আচরণ করা হলে কোনো মেধাবী কর্মকর্তা আর মন্ত্রীর পিএস বা ডিসি হতে চাইবেন না। এতে দেশের প্রশাসন ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কর্মকর্তাদেরও উচিত নয় কোনো রাজনৈতিক কর্মকান্ড জড়িত হওয়া।’
দেশের প্রশাসনিক ব্যবস্থায় ডিসিরা জেলার মুখ্য আমলা। তিনি বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের প্রশাসন ক্যাডারের সদস্য। তিনি একই সঙ্গে ভূমি রাজস্ব কর্মকর্তা বা জেলা কালেক্টর ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট। ফলে তিনি ভূমিব্যবস্থা পরিচালনা, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সমন্বয় এবং সাধারণ ও স্থানীয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে রিটার্নিং অফিসার হিসেবে কাজ করেন। ডিসি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের একজন প্রতিনিধি। তিনি তার কাজের জন্য সরকারের কাছে জবাবদিহি করেন। জেলায় সংসদ সদস্যদের পাশাপাশি তিনিও রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগের অনুমতিপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। তিনি মন্ত্রিপরিষদ সচিব এবং বিভাগীয় কমিশনারের নির্দেশ ও তত্ত্বাবধানে কাজ করেন। বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের প্রশাসন ক্যাডার হতে পদোন্নতিপ্রাপ্ত সরকারের উপসচিবদের মধ্য থেকে ডিসি নিয়োগ করা হয়।
ডিসি জেলার মুখ্য প্রটোকল অফিসার হিসেবে জেলায় সফরকারী রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর প্রটোকলের দায়িত্ব পালন করেন। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে তিনি জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভাপতি। ২০০৭ সালে বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ হলে ফৌজদারি কার্যবিধি সংশোধন করে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের বিচারিক ক্ষমতা চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটকে অর্পণ করা হয়।
ডিউটিজ অব চার্টার অনুযায়ী, ডিসি জেলার ১২০টি কমিটির সভাপতি। এ কারণে জেলায় জেলায় ডিসি এত গুরুত্বপূর্ণ। ডিসিদের মূল নিয়ন্ত্রণ মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ করলেও নিয়োগ বদলি, ছুটিসহ গুরুত্বপূর্ণ কাজের কর্তৃত্ব থাকে সরকারপ্রধানের হাতে।
সম্পাদক ও প্রকাশকঃ এ. এস.এম মুরসিদ, মোবাইল : 01728 311111
ঢাকা অফিসঃ হোল্ডিং-১৩, লাইন-৬, রোড- ১২, ব্লক-বি, মিরপুর-১১, ঢাকা-১২১৬
ফরিদপুর অফিসঃ মুজিব সড়ক, ফরিদপুর, ই-মেইলঃ [email protected]
Copyright © August, 2020-2025 @ Daily Somoyer Protyasha