রাশিদুল ইসলাম রাশেদ, লালপুর (নাটোর) প্রতিনিধি
"খাঁটি গুড়ের চেয়ে ভেজাল গুড়ের দাম কম, মানুষ খায় বেশি। খরচ কম, লাভ বেশি। এক সময় গুড়ের চেয়ে চিনির দাম বেশি ছিল। আর ইন্ডিয়ান এলসি করা গোখাদ্য চিনির পচা সিরা তখন পাওয়া যেত না। তাই কেউ গুড়ে চিনি দিতো না। যা গুড় হতো সবই ছিল খাঁটি। এখন চিনির চেয়ে খেজুর গুড়ের দাম কেজি প্রতি কমপক্ষে ৪০-৫০ টাকা বেশি। এতে গুড়ে চিনি দিলে প্রতি কেজি চিনিতে ৫০ টাকা অতিরিক্ত লাভ হয়। ইন্ডিয়ান পচা চিনিতে তো লাভ আরো বেশি। সবার দেখাদেখি আমিও করছি। তবে অন্যদের মত রং ও হাইড্রোজ (সোডিয়াম হাইড্রো-সালফেট) দিই না আমি।" কথাগুলো বলছিলেন নাটোরের লালপুরের নজরুল নামে এক গাছি।
এভাবেই কমপক্ষে ৪ হাজার গাছি চিনি, নিষিদ্ধ রাসায়নিক দ্রব্য, ফিটকিরি, চুন, রং, গোখাদ্য ইন্ডিয়ান চিনির দুর্গন্ধযুক্ত সিরা মিশ্রিত খেজুরের ভেজাল গুড় তৈরি করছেন উপজেলার আনাচে-কানাচে। গত এক সপ্তাহে উপজেলার আড়বাব, ওয়ালিয়া, এবি, বিলমাড়িয়া, দুড়দুড়িয়া, লালপুর, ঈশ্বরদী ও কাদিমচিলান ইউনিয়নের কমপক্ষে ৩০ টি গ্রাম ঘুরে ও স্থানীয়দের সাথে কথা বলে এ অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে। আর লালপুরের এই ভেজাল গুড় সারা দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ায় বাড়ছে জটিল রোগের আশঙ্কা।
আমিনুল ইসলাম নামে উপজেলার এক ধর্মীয় শিক্ষক বলেন, দীর্ঘদিন ধরে তার এলাকায় খেজুর গাছের রসের সাথে রং, চিনি, গোখাদ্য সুগারমিলের লালি ও ভারত থেকে আসা মেয়াদ উত্তীর্ণ পচা চিনির সিরা ও ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্য মিশিয়ে প্রকাশ্যে ভেজাল গুড় তৈরি হচ্ছে। দেখার কেউ নেই।
দুড়দুড়িয়ার গুড় ব্যবসায়ী টেংরা জানান, চিনির সিরা দিলে গুড় খাঁটি গুড়ের চেয়ে বেশি শক্ত ও দানাদার হয়। সহজে ভাঙে না। অন্যদিকে, খাঁটি গুড় মুখে দিলেই সহজে গলে যায়। দানা হয় মোলায়েম ও চিকন। পিঠা বানালে মিষ্টি মৌ মৌ গন্ধ বের হয়। রং দেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, এখন সাধারণত লাল ও কমলা রং মিশানো হয়। সেক্ষেত্রে কয়েকদিন পর গুড়ের রং পরিবর্তন হয়ে যায়। এছাড়া গুড় উজ্জ্বল ফর্সা দেখাতে চুন, ফিটকিরি ও হাইড্রোজ ব্যবহার করা হয়।
চলতি পথে উপজেলার রাস্তাগুলোতে দেখা যায়, শত শত ভ্যান খোলা টিনের কোটায় এলসি করা ইন্ডিয়ান চিনির দুর্গন্ধময় পচা সিরা যাচ্ছে। আড়বাবের এক ভ্যান চালক বলেন, তিনি লালপুর বাজার থেকে চিনির সিরা ভর্তি টিনের কোটাগুলো আনছেন। পৌঁছে দিবেন বিভিন্ন আড়তদারদের কাছে। এ সময় দেখা যায়, টিনের কোটাগুলোর ঢাকনা নেই। গায়ে উৎপাদন, মেয়াদ ও মূল্য সম্বলিত কোন লেবেল নেই।
দেখা যায়, উপজেলায় এখন প্রতিটি বাজারেই চিনির এই সিরা বিক্রির ডিলার আছে। এ বিষয়ে সালামপুর বাজারের ব্যবসায়ী সুমন বলেন, "আমি গোখাদ্য হিসেবে ইন্ডিয়ান চিনির সিরা বিক্রি করি। অনেক সময় গাছিরা আমাদের থেকে সরাসরি এই সিরা কিনে থাকেন। তারা কি কাজে এই সিরা ব্যবহার করেন জানা নেই।"
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্য বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. মুহাম্মাদ আব্দুজ জাহের বলেন, "এসব গুড় খেয়ে কিডনি ও লিভার অকেজো হওয়া, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ সহ শিশুদের চিন্তাশক্তি হ্রাস পাবে। দীর্ঘদিন এসব গুড় খেলে ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।"
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের কেমিস্ট প্রফেসর ড. এ.এ. সৈয়দ মোস্তফা জাহিদ বলেন, এ সকল রাসায়নিক দ্রব্য মিশ্রিত গুড় খেলে শ্বাসকষ্টের সমস্যা, গলা ফুলে যাওয়া, কাশির সাথে রক্ত পড়া এবং ফুসফুসে তরল পদার্থ নির্গত হওয়া, ত্বকে জ্বালাপোড়া এবং গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল সমস্যা, পেটে তীব্র ব্যথা, বমি, রক্তাক্ত মল, খাদ্যনালীতে জ্বালা এমনকি ক্যান্সার হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
এ বিষয়ে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের (নাটোর) সহকারী পরিচালক নাজমুল হাসান সময়ের প্রত্যাশাকে জানান, আমি নাটোর জেলায় নতুন যোগদান করেছি। বিষয়টি নিয়ে আমি অবহিত ছিলাম না। দ্রুত তথ্য সংগ্রহ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
জেলা নিরাপদ খাদ্য অধিদপ্তর কর্মকর্তা মোহাম্মদ মোফাজ্জল হোসেন জানান, উপজেলা পর্যায়ে অফিস ও লোকবল না থাকায় ঠিক ভাবে মনিটরিং করা যায় না। ইতিমধ্যে বিভাগীয় অফিসে ভ্রাম্যমাণ ল্যাবের জন্য রিকুইজিশন দেওয়া হয়েছে। ডিসি ও ইউএনও মহোদ্বয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। ল্যাবটি পেলেই অভিযান পরিচালনা করা হবে।
এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার মেহেদী হাসান সময়ের প্রত্যাশাকে জানান, উপজেলা প্রশাসন ভ্রাম্যমান আদালতের মাধ্যমে ভেজাল গুড় তৈরির কারখানায় অভিযান অব্যাহত রেখেছে। এছাড়া তিনি এলাকার মানুষকে ভেজাল গুড় তৈরির কারখানা সম্পর্কে তথ্য দিয়ে প্রশাসনকে সহযোগিতা করার অনুরোধ জানান।
সম্পাদক ও প্রকাশকঃ মোঃ মুরসিদ আহমেদ সিকদার, মোবাইল : 01728 311111
ঢাকা অফিসঃ হোল্ডিং-১৩, লাইন-৬, রোড- ১২, ব্লক-বি, মিরপুর-১১, ঢাকা-১২১৬
ফরিদপুর অফিসঃ মুজিব সড়ক, ফরিদপুর, ই-মেইলঃ [email protected]
Copyright © August, 2020-2025 @ Daily Somoyer Protyasha