নিজস্ব প্রতিনিধি
ফরিদপুরের বোয়ালমারীতে সাড়ে ৩শ কোটি টাকা ঋন খেলাপির দায়ে অ্যানোনটেক্স গ্রুপের মালিকানাধীন গোল্ডেন জুটমিলটি দেউলিয়া হয়ে নিলামে উঠেছে। পত্রিকায় নিলাম বিজ্ঞপ্তি দিয়ে টেন্ডার আহবান করেছে জনতা ব্যাংকের ঢাকা কর্পোরেট শাখা। শুক্রবার (১৫ নভেম্বর) জনতা ব্যাংকের কর্পোরেট শাখায় টেন্ডার জমা দেওয়ার শেষদিন বিকেল ৩টা পর্যন্ত সময় নির্ধারণ করা ছিল।
নিলাম বিজ্ঞপ্তি থেকে জানা গেছে, খেলাপি ঋনের পরিমান ৩৫৫ কোটি ৬ লক্ষ ২ হাজার ৯৬৮ টাকা। অভিযোগ উঠেছে, ব্যাংকের টাকা লুটপাট করার পর মিলটিকে দেউলিয়া করেছে মিল কর্তৃপক্ষ। এদিকে গোল্ডেন জুটমিলের লোন সম্পর্কে জনতা ব্যাংকের বোয়ালমারী শাখা কোন তথ্য দিতে পারেনি।
দেউলিয়া হওয়া জুটমিল সরেজমিন পরিদর্শন ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, তৎকালীন জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান অর্থনীতিবিদ ড. আবুল বারাকাতের শ্বশুর বাড়ি ফরিদপুরের বোয়ালমারী পৌরসদরের ছোলনা গ্রামে। চেয়ারম্যানের সাথে অ্যানোনটেক্স গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইউনুস বাদলের সুসম্পর্ক থাকায় জনতা ব্যাংকের ঢাকাস্থ কর্পোরেট শাখা থেকে ৩০০ কোটি টাকা ঋণ মঞ্জুর করা হয়। মিলটির প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে ড. আবুল বারাকাতের স্ত্রী শাহিদা পারভিনের বড় ভাই মিজানুর রহমান গোল্ডেন জুটমিলের নির্বাহী পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। আর মিজানুর রহমানের বড় ছেলে মহসিন হোসেন ওরফে গুড্ডু মিলটির পরিচালক। গোল্ডেন জুটমিলের পাশে তারা (পরিচালনাকারীরা) 'বোনানজা জুটমিল' নামে আরেকটি জুট মিল স্থাপন করে সেটি পরিচালনা করছেন দেউলিয়া হওয়া মিলের কর্মকর্তারাই।
অনুসন্ধানে জানা যায়, জেলার বোয়ালমারী পৌরসভার শেষ প্রান্তে কলারন এলাকায় ২০১০ সালে প্রায় ১৬ একর জমির উপর “এম এইচ গোল্ডেন জুট মিল” নামের মিলটি প্রতিষ্ঠিত হয়। ২০১২ সালের শুরুতে মিলটিতে উৎপাদন শুরু হয়। তৎকালিন জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান অর্থনীতিবিদ ড. আবুল বারাকাতের শ্বশুর বাড়ির লোকজন মিলটি পরিচালনার দায়িত্বে থাকলেও মিলটির মালিকানা ঢাকার টঙ্গীর অ্যানোনটেক্স গ্রুপের। অ্যানোনটেক্স গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইউনুস বাদলের নামে জনতা ব্যাংকের ঢাকাস্থ কর্পোরেট শাখা থেকে ৩০০ কোটি টাকা ঋণ মঞ্জুর করা হয়। ইউনুস বাদল ড. আবুল বারাকাতের ঘনিষ্টজন হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ইউনুস বাদল ও তাঁর ভাই ইউসুফ বাদল জার্মানিতে পালিয়ে গেছেন বলে একটি সূত্র থেকে জানা গেছে।
মিলটি উৎপাদন শুরুর পর থেকে ব্যাংকের ঋণের কোন কিস্তি পরিশোধ করেননি মিল কর্তৃপক্ষ। অ্যানোনটেক্স গ্রুপের মাধ্যমে গোল্ডেন জুটমিল প্রতিষ্ঠিত হলেও মিলটি পরিচালনা করতেন ড. আবুল বারাকাতের শ্বশুর বাড়ির আত্মীয়-স্বজনরা। ড. আবুল বারাকাত ফরিদপুর জেলার বোয়ালমারী উপজেলার ছোলনা গ্রামের মোকাদ্দেছ হোসাইনের মেয়ে শাহিদা পারভিনকে বিয়ে করেন। শাহিদা পারভিনের বড় ভাই মো. মিজানুর রহমান গোল্ডেন জুট মিলের নির্বাহী পরিচালক (ইডি) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। মিজানুর রহমানের বড় ছেলে মহসিন হোসেন গুড্ডু পরিচালক হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন। দেউলিয়া হওয়া 'এম এইচ গোল্ডেন জুটমিল'এর পাশেই বোনানজা জুটমিল নামে একটি প্রতিষ্ঠান স্থাপন করে মিলটি পরিচালনা করছেন এমএইচ গোল্ডেন জুটমিলের পরিচালনাকারীরা। আর গোল্ডেন জুটমিল প্রায় পরিত্যাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে।
অভিযোগ উঠেছে, 'এম এইচ গোল্ডেন জুটমিল'-এর সব যন্ত্রপাতি খুলে নিয়ে ‘বোনানজা জুটমিলে’ সেটিং করা হয়েছে। গোল্ডেন জুটমিলের নামে গৃহিত ঋনের কোন কিস্তি এবং সুদ পরিশোধ না করায় মিলটি খেলাপি হয়ে দেউলিয়া হয়েছে।
নাম প্রকাশ না করতে ইচ্ছুক 'এম এইচ গোল্ডেন জুটমিল'-এর একজন সাবেক কর্মকর্তা বলেন, 'লুটপাট করার উদ্দেশ্যেই মিলটি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। মিলের সকল যন্ত্রপাতি খুলে নিয়ে নতুন আরেকটি মিল করা হয়েছে। যার নাম দেওয়া হয়েছে ‘বোনানজা জুটমিল’। গোল্ডেন জুট মিলের নামে ৩০০ কোটি টাকা ঋন নেওয়ার পর সুদে আসলে যা সাড়ে ৩০০ কোটি ছাড়িয়ে গেছে। উৎপাদনের শুরুতে মিলটি লাভবান থাকলেও ব্যাংকের টাকা পরিশোধ করা হয়নি।'
এ ব্যাপারে জনতা ব্যাংক বোয়ালমারী শাখার ব্যবস্থাপক নীলাদ্রি ঘোষ বলেন, 'গোল্ডেন জুট মিলটির নামে ঋন মঞ্জুর করা হয় ঢাকার জনতা ব্যাংকের কর্পোরেট শাখা থেকে। এ কার্যক্রমের কোন কিছুই আমরা জানিনা। মিলটির লোন সম্পর্কে বোয়ালমারী শাখায় কোন তথ্যও নেই।'
গোল্ডেন জুটমিলের প্রশাসন বিভাগের ম্যানেজার সৈয়দ আব্দুল মান্নান জানান, 'গোল্ডেন জুটমিল অ্যানোনটেক্স গ্রুপের একটি প্রতিষ্ঠান। অ্যানোনটেক্স গ্রুপের নামে ঋন নেওয়া হয়। নরসিংদির ইউনুস বাদল, ইউসুফ বাদল অ্যানোনটেক্স গ্রুপের মালিক। তারা ব্যাংকের টাকা পরিশোধ না করায় এম এইচ গোল্ডেন জুটমিল ঋনখেলাপি হয়।' তিনি বলেন, 'কোন মিলই বর্তমানে লাভে নেই বলে তিনি দাবি করেন। লস হওয়ার কারণেই হয়তো ব্যাংকের টাকা পরিশোধ করতে পারেনি মিলটি।' গোল্ডেন জুটমিলের যন্ত্রপাতি খুলে বোনানজা মিলে লাগানোর বিষয়টি অস্বীকার করে আব্দুল মান্নান বলেন, 'এটা আমাদের সম্পদ। এটি কোন সরকারি সম্পদ নয়।'
সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, এম এইচ গোল্ডেন জুট মিলটির পরিচালনাকারী সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীই এখন পাশে নতুন প্রতিষ্ঠিত হওয়া ‘বোনানজা জুট মিলে' বসেন। এ সময় জুটমিলের নির্বাহী পরিচালক (ইডি) মো. মিজানুর রহমানের সাথে কথা হলে তিনি বলেন, 'গোল্ডেন জুটমিলে আমরা সবাই চাকরি করতাম। মিলটি খেলাপি হয়ে যাওয়ায় আমরা সেটি ছেড়ে দিয়েছি।' এম এইচ গোল্ডেন জুটমিলের পরিচালক ও বর্তমান বোনানজা জুটমিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মহসিন হোসেন গুড্ডুর সাথে কথা বলতে তাঁর মুঠোফোনে একাধিকবার কল দিলেও তিনি কল রিসিভ না করায় কথা বলা সম্ভব হয়নি। পরে তাকে ক্ষুদে বার্তা দিলেও তিনি ফোন করেননি।
সম্পাদক ও প্রকাশকঃ মোঃ মুরসিদ আহমেদ সিকদার, মোবাইল : 01728 311111
ঢাকা অফিসঃ হোল্ডিং-১৩, লাইন-৬, রোড- ১২, ব্লক-বি, মিরপুর-১১, ঢাকা-১২১৬
ফরিদপুর অফিসঃ মুজিব সড়ক, ফরিদপুর, ই-মেইলঃ [email protected]
Copyright © August, 2020-2025 @ Daily Somoyer Protyasha