আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকারের সাবেক তথ্যমন্ত্রী ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সভাপতি হাসানুল হক ইনু দেশের রাজনীতিতে আলোচিত নাম। কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা উপজেলার গোলাপনগর গ্রামের সন্তান ইনু আটকের খবরে কুষ্টিয়া জেলায় মিষ্টি বিতারণ হয়। ও তাকে নিয়ে সাধারণ মানুষ নানা মিশ্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন।
জাসদ গণবাহিনীর অন্যতম পৃষ্ঠপোষক ইনুকে নিয়ে নিজ দল জাসদেও আছে আলোচনা-সমালোচনা। বিশেষ করে জাতীয় নেতা কাজী আরেফ হত্যার ঘটনায় দলের অনেকেই মাস্টার মাইন্ড হিসেবে ইনুকে দায়ী করেন। এছাড়া কুষ্টিয়া অঞ্চলে আরও অনেক হত্যাকাণ্ডের নায়ক হিসেবে ইনুকে দায়ী করেন সাধারণ মানুষ। কুষ্টিয়া অঞ্চলে অস্ত্রের রাজনীতি ও চরমপন্থি গ্রুপগুলো একটা সময় ইনু নিয়ন্ত্রণ করতেন। এমনকি তার দলের অনেক-কর্মি এখনো অস্ত্রের রাজনীতি করেন বলেন অভিযোগ আছে।
হাসানুল হক ইনু আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের অন্যতম নেতা। ২০০৮ সালের নবম, ২০১৪ সালের দশম ও ২০১৯ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ১৪ দলের প্রার্থী হিসেবে নৌকা প্রতীক নিয়ে কুষ্টিয়া-২ আসন (ভেড়ামারা-মিরপুর) থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তিনি।
ইনু ২০১২ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর থেকে ২০১৯ সালের ৭ জানুয়ারি পর্যন্ত তথ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
আওয়ামী লীগ সরকারের সবশেষ মেয়াদে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। এছাড়া ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন ইনু।
১৪দলীয় জোটের অন্যতম নেতা হাসানুল হক ইনুর সাথে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের ছিল দা-কুমড়া সম্পর্ক। সর্বশেষ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জোট থেকে দলীয় মনোনয়ন পেলেও পরাজিত হন তিনি। নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার পর মাত্র দুইবার এলাকায় যান এই নেতা। তাই সর্বশেষ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতারা মিরপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কামারুল আরেফিনের পক্ষে ভোটে নামলে ইনুর নৌকা ডুবে যায়।
গত ১৬ বছরে আওয়ামী লীগের নৌকায় চড়ে ইনু জেলার রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করেন। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফের বাড়িও ভেড়ামারায় হওয়ার সুবাদে দুইজনের মধ্যে ছিল সাপে-নেওলে সম্পর্ক।
গত রোববার (২৫ আগস্ট) ভেড়ামারা বাসস্ট্যান্ড চত্বরে এক প্রতিবাদ সভা থেকে বিএনপি ও ছাত্রদলের নেতারা ইনুকে কট্টাক্ষ করে নানা বক্তব্য রাখেন। অশ্রাব্য ভাষায় ইনুকে গালিগালাজও করেন কয়েকজন নেতা।
পরিসংখ্যান বলছে, ২০০৮ সালের আগের তিনটি নির্বাচনে কুষ্টিয়া-২ (মিরপুর- ভেড়ামারা) আসন থেকে জাসদ থেকে মশাল প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করে বিএনপি প্রার্থীর কাছে জামানত হারান। তবে মহাজোট গঠনের পর ইনুর কপাল খুলে যায়।
একই আসন থেকে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ দলীয় মনোনয়ন চাইলেও ইনুকে আসন ছেড়ে দেওয়ার কারণে কপাল পুড়ে যায় হানিফের। হানিফকে কুষ্টিয়া-৩ (সদর) আসনে পাঠানো হয়। আর সর্বশেষ চারটি সংসদ নির্বাচনে নৌকায় চড়ে তিন বার এমপি বনে যান ইনু। এমনকি মন্ত্রীর স্বাদও গ্রহণ করেন। তথ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। যে নৌকায় চড়ে ইনু এমপি ও মন্ত্রী হন সেই আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের সাথে বিগত বছরগুলোতে ইনু ও তার দল জাসদের সম্পর্ক মোটেও ভাল যায়নি।
বিশেষ করে সর্বশেষ দুটি সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতাদের প্রবল প্রতিরোধের মুখে পড়েন ইনু। শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপে কয়েকবার ইনু উতরে গেলেও এবার ইনুর নৌকা ডুবে যায় হানিফের শিষ্য কামারুলের কাছে। শিষ্যকে দিয়ে ফাঁদ পেতে ধরাশায়ী করেন ইনুকে। ইনু ও জাসদের রাজনীতি কুষ্টিয়া থেকে বিতাড়িত করতে হানিফ উঠেপড়ে ছিলেন।
সর্বশেষ দুই বছরে আওয়ামী লীগের দুই নেতাকে হত্যার অভিযোগ ওঠে জাসদ নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে। বিশেষ করে চাঁদগ্রাম ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ নেতা সিদ্দিকুর রহমানকে কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যার পর জাসদের সাথে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের বিরোধ তুঙ্গে ওঠে। আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা ইনুর বিরুদ্ধে মিছিল ও সমাবেশ করে শাস্তি দাবি করেন।
আর এ হত্যার নেতৃত্ব দেওয়ার অভিযোগ করা হয় ইনুর অনুগত ও ডানহাত হিসেবে পরিচিত জেলা জাসদ সভাপতি আব্দুল আলীম স্বপন ও তার ভাই চাঁদগ্রাম ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল হাফিজ তপনের বিরুদ্ধে। ইনু আসামী না হলেও জাসদের জেলার শীর্ষ নেতারা আসামী হন। এরপর গত বছরের ২ আগস্ট উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা হত্যা সঞ্জয় কুমার হত্যার পর জাসদকে দায়ী করা হয়।
এ ঘটনার পর জাসদ ও বিএনপির নেতা-কর্মীদের বাড়ি-ঘর এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা চালায় আওয়ামী লীগের লোকজন। এসব নিয়ে জাসদ ও আওয়ামী লীগের সম্পর্কে আর জোড়া লাগাতে পারেনি ইনু। যার পরিণতি ভোগ করতে হয় সর্বশেষ সংসদ নির্বাচনে।
আগের রাগ ও অভিমান থেকে মাহবুব উল আলম হানিফ রাজনীতির মাঠে ইনুকে ঘায়েল করতে জেলার মিরপুরে বাড়ি শিষ্য কামারুল আরেফিনকে দাঁড় করিয়ে দেন। স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ইনুর বিরুদ্ধে ভোটের মাঠে নামলে বেকায়দায় পড়ে যান। ঢাকায় বসে কামারুলকে মাঠ থেকে সরাতে চেষ্টা করলেও শেষ পর্যন্ত না পেরে হতাশ হন ইনু। নির্বাচনে কামারুল আরেফিনের নিকট শোচনীয় পরাজয় বরণ করে মান অভিমানে আর জেলামুখী হননি খুব একটা।
জাসদ গণবাহিনীর অন্যতম পৃষ্ঠপোষক ইনুকে নিয়ে নিজ দল জাসদেও আছে আলোচনা-সমালোচনা। বিশেষ করে জাতীয় নেতা কাজী আরেফ হত্যার ঘটনায় দলের অনেকেই মাস্টার মাইন্ড হিসেবে ইনুকে দায়ী করেন। এ ছাড়া কুষ্টিয়া অঞ্চলে আরও অনেক হত্যাকাণ্ডের নায়ক হিসেবে ইনুকে দায়ী করেন সাধারণ মানুষ।
কুষ্টিয়া অঞ্চলে অস্ত্রের রাজনীতি ও চরমপন্থি গ্রুপগুলো একটা সময় ইনু নিয়ন্ত্রণ করতেন। এমনকি তার দলের অনেক কর্মী এখনো অস্ত্রের রাজনীতি করেন বলেন অভিযোগ আছে।
সর্বশেষ ভেড়ামারা আওয়ামী লীগ নেতা সিদ্দিকুর রহমান হত্যাকাণ্ডের সময় প্রকাশ্যে অস্ত্র নিয়ে মহড়া দেন ইনুর অনুগতরা। এ ছাড়া আওয়ামী লীগের নেতাদের অভিযোগ, ইনু কথায় কথায় পুলিশ দিয়ে হয়রানী করতেন নেতা-কর্মীদের। জামায়াত-বিএনপির অনেকেই ইনুর সহানুভূতি পেলেও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের নামে মামলা দিয়ে বাড়ি-ঘর ছাড়া করা হয় তার আমলে।
আলেম বিদ্বেষী ইনুর প্রতি জেলার বড় একটি অংশ চরম ক্ষুব্ধ। বিশেষ করে হেফাজত ইসলামের নেতারা ইনুর কঠোর শাস্তির দাবি জানিয়েছেন।
হেফাজত নেতা মুফতি আব্দুল লতিফ বলেন, আলেমদের নিয়ে অনেক তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করেছেন। শাপলা চত্বরে আওয়ামী লীগ সরকার যে তাণ্ডব চালিয়ে ছিল তার অন্যতম মাস্টার মাইন্ড ছিল ইনু। তাই তাকে কঠোর শাস্তির আওতায় আনতে হবে।
১৫ বছরে ইনুর ডান হাত হিসেবে বিভিন্ন ধরণের অপকর্ম করে গেছেন জেলা জাসদ এর সাধারণ সম্পাদক আব্দুল আলীম স্বপন ও তার ভাই চাঁদগ্রাম ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুর হাফিজ তপন। তাদেরও বিচার চান স্থানীয়রা।
এদিকে ১৫ বছর এমপি থাকাকালে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে তার একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল। এসব প্রতিষ্ঠানে তিনি তার পরিবারের লোকজন সভাপতি হিসেবে বসান। স্ত্রী আফরোজ হক রিনা ছাড়াও ছেলেকে সভাপতি করেন কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে। টেন্ডার হাট-ঘাট দখলে ছিল ইনুর অনুগতদের। সোমবার বিকেলে ভেড়ামারায় ইনুর নিজ ইউনিয়ন গোলাপনগর এলাকার কয়েকজনের সাথে মোবাইলে কথা হয়। ইনুর আটকের খবর এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে চাঞ্চল্যর সৃষ্টি হয়।
ভেড়ামারা উপজেলা বিএনপির সাথারন সম্পাদক এ্যাড: তৌহিদুল ইসলাম আলম বলছেন, হাসানুল হক ইনু পতিত স্বৈরাচার হাসিনার প্রধান দোসর। তার বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনসহ নানা অভিযোগ আছে। সব অভিযোগের তদন্ত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানাচ্ছি। তিনি আরো বলেন,লুটপাট করে, গরীবের হক মেরে ও স্কুল-কলেজের টাকা আত্মসাৎ করে বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন ইনু।
আতিয়ার রহমান নামের একজন ব্যবসায়ী বলেন, ইনু চতুর একজন ব্যক্তি। তিনি মানুষের সাথে মুখে মিষ্টি কথা বলে লোকজনকে ভুলিয়ে রাখতেন। তবে ষড়যন্ত্রের রাজনীতি করতেন সব সময়। দৃশ্যমান কোনো উন্নয়ন করতে না পারলেও তার দলের কতিপয় নেতা-কর্মী এখন কোটি কোটি টাকার মালিক।
হাসানুল হক ইনুর সম্পদের বিষয়ে তিনি বলেন, টানা তিন মেয়াদে এমপি থাকায় নিজ এলাকা গোলাপনগরে একটি বাড়ি ছাড়া উপজেলার কোথাও তার ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে কোনো সম্পদ নেই। তবে ঢাকায় তার ও তার ছেলেদের নামে অনেক সম্পদ আছে বলে শুনেছি।
ভেড়ামারা উপজেলা আওয়ামী লীগের এক সিনিয়র নেতা আবু দাউদ বলেন, ইনু এমপি থাকাকালীন কোনো সুযোগ-সুবিধা আওয়ামী লীগের কাউকেই দেয়নি। তার দলের তিন থেকে চার জন নেতা কোটি কোটি টাকা কামিয়ে নিয়েছেন। ইনু তাদের এ সুযোগ করে দিয়েছেন। আর মিরপুর উপজেলা জাসদের সাধারণ সম্পাদক আহম্মদ আলী সব কাজের কমিশন ইনুর স্ত্রী আফরোজ হক রিনাকে দিতেন বলে সবাই বলাবলি করে। তবে ইনুর পুরাতন একটি বাড়ি ছাড়া জেলায় কোনো সম্পদ আছে বলে জানা নেই।
এসব বিষয়ে কথা বলার জন্য জেলা জাসদ সভাপতি গোলাম মহসিনের মোবাইলে ফোন করা হলে তা বন্ধ পাওয়া গেছে। এছাড়া ভেড়ামারা উপজেলা জাসদের শীর্ষ নেতাদের মোবাইল নম্বরও বন্ধ রয়েছে।
জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি অধ্যাপক শহীদুল ইসলাম বলেন, জাসদ সভাপতি ইনু ভারতে পালিয়ে থাকা হাসিনার প্রধান দোসর। তারা ১৫ বছরে বাংলাদেশকে শোষণ করেছে। তাই ইনু এর দায় এড়াতে পারে না। তার বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনসহ নানা অভিযোগ আছে। এসব অভিযোগ তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে হবে।
সম্পাদক ও প্রকাশকঃ মোঃ মুরসিদ আহমেদ সিকদার, মোবাইল : 01728 311111
ঢাকা অফিসঃ হোল্ডিং-১৩, লাইন-৬, রোড- ১২, ব্লক-বি, মিরপুর-১১, ঢাকা-১২১৬
ফরিদপুর অফিসঃ মুজিব সড়ক, ফরিদপুর, ই-মেইলঃ [email protected]
Copyright © August, 2020-2025 @ Daily Somoyer Protyasha