কুষ্টিয়ায় জেলা আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতির ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) জাল জালিয়াতি করে ভুয়া দাতা-গ্রহীতার মাধ্যমে শত কোটি টাকার জমি হাতিয়ে নেওয়ার মামলায় জড়িত থাকার অভিযোগে জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি হাজী রবিউল ইসলামসহ ৪১ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দেওয়া হয়েছে। তবে ৪১ জনের মধ্যে ছয়জন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন।
এ জালিয়াতি চক্রের ৪১ জনের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।
গত ৩০ জুলাই বিকেলে কুষ্টিয়া সিআইডির অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার জিয়া উদ্দিন আহম্মেদ স্বাক্ষরিত ও কুষ্টিয়া মডেল থানায় করা চাঞ্চল্যকর এই জালিয়াতি মামলার ৩০৫ নম্বর অভিযোগপত্রটি আদালতে দাখিল করা হয়।
কুষ্টিয়া অতিরিক্ত চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আমলি আদালত-১ এর বেঞ্চ সহকারী মতিউর রহমান এই তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
ভুক্তভোগী ও মামলার বাদী কুষ্টিয়া শহরের বাসিন্দা এমএমএ ওয়াদুদ বলেন, আমিসহ আমার পরিবারের আরও ৫ সদস্যের নাম ও তথ্য দিয়ে জাল জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করেন আসামিরা। আমাদের নামে ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করে ভুয়া মালিক সাজিয়ে আমার শত কোটি টাকার সম্পত্তি বিক্রি করে দেওয়া হয়। ২০১৭ সাল থেকে তারা এগুলো শুরু করে। এরপর বিষয়টি জানতে পেরে আমি মোট ৮ থেকে ১০টি মামলা করি। এ ঘটনায় জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানাচ্ছি। দ্রুত মামলার রায়ের দাবি জানাচ্ছি।
কুষ্টিয়া মডেল থানায় দায়ের হওয়া মামলার আসামিরা হলেন, কুষ্টিয়া জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান, কুষ্টিয়া চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সাবেক সভাপতি, জেলা আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি হাজী রবিউল ইসলাম, জাহানারা বেগম, আমির হোসেন, সদর উদ্দিন, পিঞ্জিরা খাতুন, আঞ্জেরা খাতুন, ফারুক মন্ডল, মুহিবুল ইসলাম, জাহিদুল ইসলাম, মহিবুল ইসলাম, খালিদ বীন সাদী, হালিম উদ্দিন, আশরাফুজ্জামান সুজন, খয়বার শেখ, রঙ্গিলা খাতুন, মহিরন খাতুন, হারুনুর রশিদ, আমিরুল ইসলাম, হুর আলী, সুমন হোসেন, কামরুজ্জামান কাবিল, দেলোয়ার হোসেন, মিন্টু খন্দকার, জরিনা খাতুন, মোমেনা খাতুন, জীবন খাতুন, ছানোয়ারা খাতুন, হেনা, জাহানারা, মিলন হোসেন, নজরুল ইসলাম, মোস্তফা করিম, মোরশেদুল হাসান ও ছরোয়ার হোসেন। নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের উপসচিব (সাবেক জ্যেষ্ঠ জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা) নওয়াবুল ইসলাম, ফরিদপুরের অতিরিক্ত আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা (সাবেক কুষ্টিয়া সদর উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা) জিয়াউর রহমান, মাগুরা সদরের উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা (সাবেক কুষ্টিয়া সদর উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা) অমিত কুমার দাস ও কুষ্টিয়া সদর উপজেলা নির্বাচন কার্যালয়ের অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক জিএম সাদিক। কুমারখালী থানায় দায়ের হওয়া মামলার একমাত্র আসামি হলেন কুষ্টিয়া সদর উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা (সাবেক কুমারখালী উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা) ছামিউল আলম।
দায়ের হওয়া মামলা তদন্ত করতে গিয়ে জালিয়াতিতে আনিসের সম্পৃক্ততার প্রমাণ পায় সিআইডি। সে সময় জেলা নির্বাচন কার্যালয়ের অফিস সহকারী হিসেবে কর্মরত ছিলেন। গ্রেপ্তারের পর কুষ্টিয়ার অতিরিক্ত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন আনিসুর রহমান আনিস। তাদেরকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয় নির্বাচন কমিশন।
পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডির অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার জিয়াউদ্দিন আহম্মেদ জানান, ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে কুষ্টিয়া মডেল থানায় করা মামলাটি পর্যায়ক্রমিক তদন্ত করেন পুলিশ পরিদর্শক আকিবুল ইসলাম, সহকারী পরিদর্শক সুজিত কুমার কর, সহকারী পুলিশ সুপার দেওয়ান আবুল হোসেন ও পুলিশ পরিদর্শক হারুন অর রশীদ।
মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, বাদী কুষ্টিয়া শহরের এনএস রোডের বাসিন্দা এম এম এ ওয়াদুদ। বাদীর পৈত্রিক সম্পত্তির ওয়ারিশান হিসেবে গোটা পরিবারের ছয় সদস্যের এনআইডি জালিয়াতি করে শতকোটি টাকার সম্পত্তি দখল করে একটি প্রভাবশালী চক্র। ২০১৭ সাল থেকে জালিয়াত চক্রটি জাল দলিল করে, এবং এম এম এ ওয়াদুদসহ তার স্ত্রী, ছেলে এবং মেয়ে এনআইডি জাল করেন। এগুলো কাজে লাগিয়ে সমস্ত সম্পত্তির পাওয়ার অফ অ্যাটর্নি করে নেন। এর বিরুদ্ধে মামলা করা হলে সিআইডি ওই দলিল জব্দ করে। কিন্তু তারা আবার নকল দলিল তৈরি করে এম এম এ ওয়াদুদ ও তার পরিবারের সদস্য সেজে শত কোটি টাকার সম্পত্তি আমলাপাড়ার মহিবুল ইসলামের কাছে বিক্রি করে দেন।
মামলার বাদী এম এম এ ওয়াদুদ জানান, জাল এনআইডিগুলো নির্বাচন কমিশন (ইসি) বন্ধ করে দেওয়ার পরেও এগুলো ব্যবহার করে জালিয়াত চক্রটি রেজিস্ট্রি অফিসের কিছু অসাধু ব্যক্তির সাহায্যে একাধিক দলিল করেন। বিষয়টি টের পাওয়ার পরই ২০১৯ সালে আমি জালিয়াতির অভিযোগে কুষ্টিয়া মডেল থানায় মামলা করি।
মামলাটির তদন্ত শেষে জমা আদালতে দাখিল করা চার্জশিটে কুষ্টিয়ার পূর্ব মজমপুরের মৃত মতিয়ার রহমান বিশ্বাসের ছেলে আসাদুর রহমান বাবু (৫১), তৎকালীন কুষ্টিয়া শহর যুবলীগের আহ্বায়ক আশরাফুজ্জামান সুজন, আমলাপাড়ার হাজী মোহাম্মদ আলীর ছেলে মহিবুল ইসলামসহ মোট ৪১ জনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে একজন পলাতক আছেন আর বাকি সবাই জামিনে মুক্ত আছেন। এই তালিকার ১৪ নম্বরে রয়েছেন কুষ্টিয়া জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি হাজী রবিউল ইসলামের নাম।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সিআইডি কুষ্টিয়ার অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার জিয়াউদ্দিন আহম্মেদ বলেন, আমরা পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত করে সত্যতার ভিত্তিতে চার্জশিট দিয়েছি।
তিনি বলেন, মামলাভুক্ত সাক্ষ্যপ্রমাণ ছাড়াও হাজী বরিউলের বিরুদ্ধে এই জালিয়াতি চক্রের সঙ্গে সঙ্গে জড়িত থাকার বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণাদি মামলার নথিপত্রে সংযুক্ত আছে। এছাড়া মামলার প্রধান দুই আসামি আদালতে ১৬৪ ধারায় দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতেও এই এনআইডি জালিয়াতি ও সম্পত্তি হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনায় হাজী রবিউলের প্রত্যক্ষ ইন্ধন, প্ররোচনা ও সার্বিক সহযোগিতার কথা স্বীকার করেছেন।
জিয়াউদ্দিন বলেন, আমরা ৩৫ জনের নাম উল্লেখ করে আদালতে চার্জশিট দিয়েছি। এর বাইরে ছয়জনের বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা পেলেও তারা সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী হওয়ায় তাদের বিষয়ে আদালতকে অবহিত করেছি। এখন শুনানির দিন ধার্য করলে সেখানে আদালত নথিপত্র দেখে পক্ষে-বিপক্ষে কথা শুনানি করে সিদ্ধান্ত ও আদেশ দেবেন।
এ বিষয়ে জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি হাজী রবিউল ইসলাম বলেন, আমি জালিয়াতির সঙ্গে কোনো ভাবেই জড়িত নয়। তৎকালীন পুলিশ কর্মকর্তার সম্পূর্ণ আক্রোশের শিকার হয়েছিলাম। আমার নামে মামলাটি তাদের মনগড়া। আমার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বানোয়াট। এ ঘটনার সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। আমি আইনিভাবে লড়াই চালিয়ে যাব। সত্যের জয় হবে ইনশাল্লাহ।
সম্পাদক ও প্রকাশকঃ মোঃ মুরসিদ আহমেদ সিকদার, মোবাইল : 01728 311111
ঢাকা অফিসঃ হোল্ডিং-১৩, লাইন-৬, রোড- ১২, ব্লক-বি, মিরপুর-১১, ঢাকা-১২১৬
ফরিদপুর অফিসঃ মুজিব সড়ক, ফরিদপুর, ই-মেইলঃ [email protected]
Copyright © August, 2020-2025 @ Daily Somoyer Protyasha