পদবিতে ‘মেডিক্যাল অফিসার’। এক সময় ছিলেন কেয়ারটেকার। তাও আবার হোমিওপ্যাথিক মেডিক্যাল কলেজের। সেখান থেকে তিনি বাংলাদেশ হোমিওপ্যাথিক মেডিক্যাল বোর্ডের চেয়ারম্যান। পুঁইয়ের ডগার মতো সাফল্যের (?) সিঁড়ি বেয়ে তর তর করে উঠে বসেন পদের শীর্ষে। গড়েছেন শত কোটি টাকারও বেশি বিত্ত-বৈভব। দেশ-বিদেশে করেছেন বাড়ি, গাড়ি, ফ্ল্যাট, প্লট এবং বেশকয়েকটি প্রতিষ্ঠান। সবকিছুই তিনি অর্জন করেছেন সরকারি পদে বহাল থাকার আশীর্বাদে।
চাকরির চেয়ারে থেকে ব্যবসা! চাকরি বিধি অনুযায়ী এটি এমনিতেই অপরাধ। তার ওপর ধারণ করেছেন রাজনৈতিক দলের পদ-পদবি। রাজনীতির তকমা লাগিয়েই ‘বৈধতা’ নিচ্ছেন নিয়োগ বাণিজ্য, প্রতিষ্ঠান অনুমোদন বাণিজ্যসহ সকল অবৈধ কার্যকলাপের। তার বিরুদ্ধে রয়েছে জাল-জালিয়াতি, ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে অর্থ আত্মসাৎ, নামে-বেনামে কোটি কোটি টাকার সম্পদ অর্জন এবং ভারত ও কানাডায় অর্থ পাচারের অভিযোগ। সুনির্দিষ্ট তথ্য সম্বলিত এসব অভিযোগের ভিত্তিতে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) অনুসন্ধান করলেও বার বার দিয়ে চলেছে দায়মুক্তি। বিরাট অঙ্কের নজরানার বিনিময়ে সংস্থাটির কাছ থেকে প্রতিবারই বাগিয়ে নিচ্ছেন দায়মুক্তির সনদ। যার সম্পর্কে এসব তথ্য, তিনি আর কেউ নন, বাংলাদেশ হোমিওপ্যাথিক বোর্ডের চেয়ারম্যান দিলিপ কুমার রায়।
দুদকের রেকর্ডপত্রে দেখা যায়, দিলিপ রায় ১৯৮২ সালে বাংলাদেশ হোমিওপ্যাথিক মেডিক্যাল কলেজের কেয়ারটেকার হিসেবে নিয়োগ পান। নানা লাইনঘাট করে পদোন্নতি নেন ‘মেডিক্যাল অফিসার’ পদে। এই পদ থেকে তিনি এক লাফে উঠে যান হোমিওপ্যাথিক মেডিক্যাল বোর্ডের চেয়ারম্যানের চেয়ারে। দীর্ঘদিন এ পদ দখলে রেখে গোটা সেক্টরকে রেখেছেন পদানত। কায়েম করেছেন নৈরাজ্য, স্বেচ্ছাচারিতা আর দুর্নীতির স্বর্গরাজ্য। সরকারের শীর্ষপর্যায় থেকে দুর্নীতি প্রশ্নে ‘জিরো টলারেন্স’ ঘোষণা করা হলেও দিলিপ রায় সব সময় থেকেছেন অধরা। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় তার বিষয়ে একাধিক তদন্ত করেছে। তদন্ত শেষে তার বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য উল্লেখ করে ব্যবস্থা নিতে দুদকে পাঠায়। কিন্তু সংস্থার কতিপয় দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তার সহায়তায় প্রতিবারই পেয়েছেন দায়মুক্তি।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এক নথিতে উল্লেখ করা হয়, দিলীপ কুমার নিজেকে ‘হোমিও ডাক্তার’ দাবি করলেও মূল লক্ষ্য এই সেক্টর থেকে যেনতেন প্রকারে অর্থ হাতিয়ে নেয়া। এই কাজে ব্যবহার করছেন ক্ষমতাসীন দলের পদ-পদবি।
দুদকের নথি বলছে, সরকারি পদে থেকেও ডা: দিলিপ রায় নামে-বেনামে অর্জন করেছেন বিপুল সম্পদ। এর মধ্যে রয়েছে-রাজধানীর ২৪, জয়কালি মন্দিরে অবস্থিত ‘রায় হোমিও হল’। এই নামে তিনি করছেন হোমিওপ্যাথিক ওষুধের পাইকারি ব্যবসা। আছে ‘গ্রামীণ জুয়েলার্স লিমিটেড’। ১৫, বায়তুল মোকাররম মসজিদ মার্কেটে এটির প্রধান শাখা। একই মার্কেটের দ্বিতীয় তলায় রয়েছে আরেকটি শাখা। নিউমার্কেট এবং উত্তরা রাজউক ভবনে রয়েছে ২টি শাখা। ‘গ্রামীণ ডায়মন্ড লিমিটেড’র বায়তুল মোকাররম মসজিদ মার্কেটে রয়েছে হীরার ব্যবসা। ‘ভিশন জুয়েলারি লিমিটেড’ নামে আরেকটি স্বর্ণের ব্যবসা রয়েছে। এটির প্রধান শাখা বায়তুল মোকাররম মসজিদ মার্কেট। পান্থপথ বসুন্ধরা সিটিতে রয়েছে একটি শাখা। ‘গ্রামীণ ফুড লি:’ নামে বেকারি এবং মিষ্টির ব্যবসা। বায়তুল মোকাররম মসজিদ মার্কেটে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান শাখা। এছাড়া নিউ মার্কেট, মতিঝিল, বাসাবো এবং মাতুয়াইলে ‘গ্রামীণ ফুড’র শাখা রয়েছে। ফরিদপুর ও বোয়ালমারীতে রয়েছে ২টি ইট ভাটা। রাজধানীর সেগুনবাগিচায় রূপায়ন টাওয়ারে ২টি ফ্ল্যাট, শান্তিনগর ‘স্কাই ভিউ অ্যাপার্টমেন্ট’-এ ২টি ফ্ল্যাট। রাজধানীর মাতুয়াইল, ফরিদপুর শহর এবং বোয়ালমারীতে ১টি করে ফ্ল্যাট রয়েছে। ভারতের কোলকাতায় রয়েছে আলীশান বাড়ি এবং আবাসিক হোটেল। কানাডায় রয়েছে ‘সেকেন্ড হোম’। এর বাইরে রয়েছে তার হুন্ডি ব্যবসা। যেসবের আর্থিক মূল্য শত কোটি টাকারও বেশি।
তার ক্ষমতার অপব্যবহার এবং অবৈধ অর্থ-সম্পদ অর্জনের অভিযোগটি অত্যন্ত পুরনো। ওয়ান-ইলেভেন পরবর্তী সরকারে ‘দুর্নীতি ও গুরুতর অপরাধ দমন সংক্রান্ত টাস্কফোর্স’ দুর্নীতিবাজ ব্যক্তিদের যে তালিকা করে সেখানে নাম ছিলো দিলিপের। ওই সময় তার বিরুদ্ধে একটি অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। বিপুল অর্থের বিনিময়ে সেই অনুসন্ধান তিনি দীর্ঘদিন ধামাচাপা দিয়ে রাখেন। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় এলে তিনি সরকারদলীয় রাজনৈতিক ছায়াতলে আশ্রয় নেন। তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী এবং মন্ত্রণালয়ের কতিপয় দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তার ‘কাছের মানুষ’ হয়ে যান তিনি। তা সত্ত্বেও ২০১৪ সালে তার বিরুদ্ধে দুদকে ধামাচাপা দিয়ে রাখা অনুসন্ধানটি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। ওই সময় অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ সম্পর্কে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। পরে অদৃশ্য ইশারায় অনুসন্ধান পর্যায় থেকেই দায়মুক্তি ঘটে দিলিপের। দুদকের তৎকালীন উপ-পরিচালক মফিদুল ইসলাম তাকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতির সুপারিশ করেন। এর ৫ বছর পর স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে দুদকে আরেকটি প্রতিবেদন পাঠানো হয় দিলিপ রায়ের বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলেও দুদক নিজস্ব তফসিলভুক্ত অপরাধের অনুসন্ধান না করে ২০২১ সালের ১৪ অক্টোবর সুকৌশলে ‘প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ’ করার জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে ফেরত পাঠায়। এভাবেই দায়মুক্তি প্রদান কিংবা ‘নিষ্পত্তি’ করা হয় দিলিপের অনুসন্ধান। জানা গেছে, ইকবাল মাহমুদ নেতৃত্বাধীন কমিশনের তৎকালীন মহাপরিচালক ও অভিযোগ যাচাই-বাছাই কমিটি’র আহ্বায়ক কেএম সোহেল দিলিপের দায়মুক্তির চিঠিতে (স্মারক নং-০০.০১.০০০০.৫০৩.২৬.১২৯.২১-২৭৭৩৪) স্বাক্ষর করেন।
এদিকে দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জন এবং অর্থপাচারের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ সত্ত্বেও কি করে কমিশন দায়মুক্তি দিলো-জানতে চাওয়া হয় একজন মহাপরিচালকের কাছে। জবাবে তিনি বলেন, তফসিলভুক্ত কোনো অভিযোগ থেকে দায়মুক্তি প্রদানের আইনগত কোনো সুযোগ দুদকের নেই। সুনির্দিষ্ট তথ্য-উপাত্ত পেলে অভিযোগ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিষয়ে পুনরায় অনুসন্ধানের এখতিয়ার দুদকের রয়েছে। দুর্নীতির প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও অনুসন্ধান নথিভুক্ত করা হয়েছে-এমন রেকর্ড বর্তমান কমিশনের নেই। এদিকে অভিযোগের বিষয়ে কথা বলতে ফোন করা হয় দিলিপ কুমার রায়কে। অপরপ্রান্ত থেকে ফোন রিসিভি করেন রামচন্দ্র পরিচয়ে এক ব্যক্তি। জানালেন, এটি রায় হোমিও হল। দিলিপ বাবু এ মুহূর্তে চেম্বারে নেই। মাঝে মধ্যে আসেন। গ্রামীণে ফোন দিলে হয়তো পাওয়া যেতে পারে।
ইনকিলাব অনলাইন, ২৫ ফেব্রয়ারী '২৪
সম্পাদক ও প্রকাশকঃ মোঃ মুরসিদ আহমেদ সিকদার, মোবাইল : 01728 311111
ঢাকা অফিসঃ হোল্ডিং-১৩, লাইন-৬, রোড- ১২, ব্লক-বি, মিরপুর-১১, ঢাকা-১২১৬
ফরিদপুর অফিসঃ মুজিব সড়ক, ফরিদপুর, ই-মেইলঃ [email protected]
Copyright © August, 2020-2025 @ Daily Somoyer Protyasha