নৌপরিবহন অধিদপ্তরের চিফ ইঞ্জিনিয়ার অ্যান্ড শিপ সার্ভেয়ার ড. এস এম নাজমুল হকের স্ত্রী সাহেলা নাজমুল বাড্ডায় পাঁচ কাঠার একটি প্লটের ক্রয়মূল্য দেখিয়েছেন ২ লাখ ৫০ হাজার। প্রতি কাঠা জমির মূল্য দেখান ৫০ হাজার টাকা। রাজধানী উন্নয়ন কর্র্তৃপক্ষের (রাজউক) এস্টেট ও ভূমি শাখার কর্মকর্তারা জানান, বাড্ডার কোথাও ৫০ হাজার টাকার জমি নেই। তারা বলেন, বাড্ডার প্রতি কাঠা জমির মূল্য প্রায় এক কোটি টাকা।
এ হিসাবে ওই প্লটটির বাজারমূল্য প্রায় পাঁচ কোটি টাকা। শুধু বাড্ডায় নয়, ঢাকা ও ঢাকার বাইরে ১০টি স্থানে প্লট, ফ্ল্যাট ও দোকান রয়েছে তার। এর বাইরে রয়েছে বিলাসবহুল গাড়ি, স্বর্ণালংকার, ব্যাংক-ব্যালেন্সসহ আরও কয়েক কোটি টাকা। সব মিলিয়ে তার প্রায় ৫০ কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে। স্বামী-স্ত্রী যাতে সরিয়ে ফেলতে না পারেন সেজন্য সব সম্পদ ক্রোক (জব্দ) করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ক্রোকাদেশ জারির জন্য সম্প্রতি ঢাকা মহানগর সিনিয়র জজ আদালতে আবেদন করা হয়েছে। দুদক ও আদালত সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
দুদকের তদন্ত সূত্রে জানা গেছে, সাহেলা নাজমুলের স্বামী প্রকৌশলী ড. এস এম নাজমুল হক চাকরিকালে ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল সম্পদ করেছেন এমন অভিযোগ জমা পড়ে দুদকে। কমিশন অভিযোগের অনুসন্ধান করে প্রতিবেদন দিতে সংস্থাটি মো. হাফিজুল ইসলামকে নিয়োগ করে। স্বামীর দুর্নীতির অনুসন্ধান করতে গিয়ে সাহেলা নাজমুলের অবৈধ সম্পদ অর্জনের তথ্য বেরিয়ে আসে। এরপর তার সম্পদের হিসাব দাখিলের জন্য নোটিস দেয় দুদক। নোটিস পেয়ে তিনি দুদকে সম্পদবিবরণী দাখিল করেন। বিবরণীতে তিনি স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের মূল্য দেখান প্রায় তিন কোটি টাকা। দুদক কর্মকর্তা দীর্ঘ অনুসন্ধান শেষে সাহেলা নাজমুল ও তার স্বামী নাজমুল হকের বিরুদ্ধে মামলার সুপারিশ করেন।
কমিশন প্রতিবেদন যাচাই করে মামলার অনুমোদন দেয়। গত ৩১ জুলাই তাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়। এতে তাদের বিরুদ্ধে অবৈধভাবে ২ কোটি ৬৪ লাখ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ আনা হয়। সংস্থাটির উপপরিচালক মো. হাফিজুল ইসলাম বাদী হয়ে দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয় ঢাকা-১-এ মামলাটি করেন। জানা গেছে, নাজমুল হকের স্ত্রী সাহেলা নাজমুলের বিরুদ্ধে মামলার তদন্ত চলছে। উপপরিচালক মো. হাফিজুল ইসলাম এর তদন্ত করছেন। তদন্তে দেখা গেছে, তিনি সম্পদের যে মূল্য দেখিয়েছেন বাস্তবে তার মূল্য অনেক বেশি। স্বামী-স্ত্রী এসব সম্পদ যাতে অন্যের কাছে হস্তান্তর করে সরিয়ে ফেলতে না পারেন সেজন্য ক্রোকাদেশ জারির জন্য ঢাকা মহানগর সিনিয়র জজ আদালতে আবেদন করা হয়েছে। আদালত সব সম্পদ ক্রোক করে তা দেখভালের জন্য ঢাকা জেলা প্রশাসককে ‘রিসিভার’ হিসেবে নিয়োগ করেছে।
জানতে চাইলে দুদকের পাবলিক প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট মাহমুদ হোসেন গত বুধবার সন্ধ্যায় বলেন, ‘দুদকের আবেদনে আদালত সাহেলা নাজমুলের স্থাবর সম্পত্তি ক্রোক ও অস্থাবর সম্পত্তি ফ্রিজ করার আদেশ দিয়েছে। বুধবারেই ক্রোক করা সম্পত্তি পরিচালনার জন্য “রিসিভার” নিয়োগের আবেদন করা হয়েছে। আদালত ঢাকা জেলা প্রশাসককে রিসিভার নিয়োগ দিয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার রিসিভার নিয়োগের আদেশ হয়েছে।’
জানা গেছে, সাহেলা নাজমুলের ঢাকার বাড্ডা থানার বড়ুয়া মৌজায় ৫ কাঠার জমি আছে, যার মূল্য দেখানো হয় ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা। কিন্তু ওই মৌজায় প্রতি কাঠা জমি এক কোটি টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। এ হিসাবে জমির বাজারমূল্য প্রায় ৫ কোটি টাকা। ঢাকার তুরাগ থানার ভাটুলিয়া মৌজায় সাড়ে ১৬ শতাংশ জমি আছে, যার মূল্য দেখানো হয় ২৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা। ওই এলাকায় প্রতি শতাংশ জমি বিক্রি হচ্ছে ৩০ থেকে ৩৫ লাখ টাকা কাঠা দরে। এই জমির বাজারমূল্য প্রায় ৫ কোটি টাকা। তুরাগ থানার ভাটুলিয়ায় ৩৩ শতাংশ জমির ক্রয়মূল্য ২৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা দেখান, বাস্তবে মূল্য প্রায় ১০ কোটি টাকা। রাজউকের উত্তরা ১৮ নম্বর সেক্টরে ১ হাজার ৬৫০ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট রয়েছে তার, যার মূল্য প্রায় এক কোটি টাকা। রাজউকের পূর্বাচল প্রকল্পে প্রাতিষ্ঠানিক প্লটের (আটলান্টিক মেরিটাইম একাডেমি লিমিটেড নামের প্রতিষ্ঠানের তিন বিঘা জমির এক ষষ্ঠমাংশ অর্থাৎ ১০ কাঠা) জমি তার। এ জমির বাজারমূল্য ১০ কোটি টাকার বেশি। ওই প্রতিষ্ঠানের পরিচালক হিসেবে এক হাজার টাকা মূল্যের এক হাজারটি শেয়ার আছে তার, যার মূল্য ১০ লাখ টাকা। সিদ্বেশ্বরীর ৭৭ নম্বর বাড়ির দোতলায় ৭০০ বর্গফুটের একটি দোকানের ইজারা মূল্য ১০ লাখ ২৫ হাজার টাকা দেখানো হয়, বাস্তবে মূল্য অনেক বেশি। ঢাকার বাইরে খুলনার বানিয়া খামার মৌজার ৩৭/১, রায়পাড়া রোডের দুই কাঠা জমিতে তিনতলা বাড়ি আছে, যার মূল্য দেখানো হয়েছে ১০ লাখ টাকা। স্থানীয়রা বলেছেন, ওখানকার প্রতি কাঠা জমির দাম ২৫ থেকে ৩০ লাখ টাকা। বাড়ি নির্মাণে প্রায় এক কোটি টাকা খরচ হয়েছে।
তদন্ত সূত্রে জানা গেছে, মৌচাকের আনারকলি মার্কেটে মৃদুলা শাড়িজ প্রতিষ্ঠানে ২৭ লাখ ৫০ হাজার ও জামদানি কুটির শাড়িজে ২৩ লাখ ৯৮ হাজার ৩৭৫ টাকা বিনিয়োগ দেখানো হয়েছে। এ ছাড়া তার একটি গাড়ি, ৪০ ভরি সোনা, ৩০ হাজার টাকার আসবাবপত্র, ৫০ হাজার টাকার টিভি, ফ্রিজ, ফ্যান ও ওভেন; সোনালী ব্যাংকের শাখায় ১ লাখ ৪৯ হাজার ৪৭২ টাকা; জনতা ব্যাংকের মৌচাক শাখায় ৫ লাখ ২৮ হাজার ৬০৪ টাকা; প্রিমিয়ার ব্যাংকের মৌচাক শাখায় ৯ লাখ ৮০২ টাকা; হাতে নগদ ৪ লাখ ১৫ হাজার টাকা এবং লিমড়া জেনারেল ট্রেডিংয়ে ১ কোটি ৭০ লাখ টাকা থাকার প্রমাণ পেয়েছে দুদক। মৃদুলা শাড়িজের জন্য ২৫ লাখ ২৫ হাজার ও জামদানি কুটির শাড়িজের জন্য ১৮ লাখ টাকার কাপড় বাকিতে কেনার কথা বলা হলেও এমন কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।