প্রকৃতির সৌন্দর্যময় টিয়া পাখি আমাদের দেশে অতি সুপরিচিত ও সুদর্শন পাখি। শরীরে অপূর্ব সুন্দর সবুজ রঙ। এমন রঙের সাথে মিল রেখে পাখি বিজ্ঞানীরা এর নামকরণ করেছেন সবুজ টিয়া।
এরা বাংলাদেশের সুলভ আবাসিক পাখি। এরা সবুজ বনভূমি, পাতাঝরা বন, আবাদি জমি, বাগান ও লোকালয়ে বিচরণ করে।
সচারাচর ছোট ছোট দলে ঘুরে বেড়ায়। ফুল ও ফলদ গাছের ঘেরা বাগান ও শস্যক্ষেতে এসে খাবার খায়।
তবে বর্তমানে এ পাখিটি ভেড়ামারায় খুব কম চোখে পরছে। কালেভাদ্রে হয়তো দেখা যায়। প্রজনন-জনিত সমস্যা কারণে এ প্রজাতিটি ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে পড়ছে।
গাছের প্রাকৃতিক কোটরে বাসা বাঁধে। তবে প্রথম পছন্দ নারিকেল গাছের কোটর। এ ছাড়াও কাঠ ঠোকরার পরিত্যক্ত বাসায়ও ডিম পাড়ে। ডিমের সংখ্যা দুই-চারটি। ডিম ফুটতে সময় লাগে প্রায় তিন সপ্তাহ।
প্রকৃতির সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে টিয়া পাখির ভূমিকা অপরিসীম। বাংলা সাহিত্য, সংষ্কৃতি আর আদি ঐতিহ্যে লালিত গল্প-কাহিনী-পালাগানে রয়েছে টিয়া পাখির সরব উপস্থিতি।
এক সময় কুষ্টিয়ার ভেড়ামারার ৬টি ইউনিয়নের গ্রামে-গঞ্জে বিশেষ করে বনে বাঁদাড়ে অবাধে ঘুরে বেড়াতো টিয়াসহ বহু প্রজাতির পাখি। কিন্তু গত এক দশক সময় ব্যবধানে পাল্টে গেছে সে চিত্র। এখন আর আগের মতো চোখে পড়ে না প্রকৃতির অলংকারখ্যাত টিয়া পাখির অবাধ বিচরণ। কালেভাদ্রে দেখা মেলে টিয়া পাখির। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বন-জঙ্গল উজাড় হয়ে যাচ্ছে। গাছ পালা কেটে বসতি গড়ার কারণে এখন বিলীন হয়ে যাচ্ছে পাখিদের অভয়ারণ্য।
গাঢ় রঙের আভিজাত্য, সুন্দর চলন-বলন, সহজেই পোষ মানা এবং বাকপটুতার কারণেই মানুষের কাছে অতি জনপ্রিয় এই টিয়া পাখিটি।
জানুয়ারি থেকে জুলাই এদের প্রজনন মৌসুম। তখন এরা গাছের কোটোরে কাঠঠোকরাদের পরিত্যাক্ত বাসায় বা পুরানো দালানের ফাটলে বাসা করে ডিম দেয়। সবুজ টিয়ার ছানারা গাছের গর্তের মধ্যে থাকে। তবে তাদের আবাসস্থল বিনষ্ট হওয়ার কারণে তাদের অবস্থা বিছুটা বিপন্ন বলে জানালেন পাখি প্রেমিক ভেড়ামারার রুবেল।
ভেড়ামারা উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো: আব্দুর রউফ সরকার জানান, টিয়ারা সহজেই পোষ মানে এবং কিছুটা মানুষের মতো করে কথা বলতে পারে। আর এটিই বিভিন্ন প্রজাতির টিয়াদের জন্য চরম বিপদের কারণ হয়েছে। এর জন্যই বর্তমানে প্রচুর পরিমানে টিয়া অবৈধভাবে ধরা ও বিক্রি করা হয়। বন্যপ্রাণী নিরাপত্তা ও সংরক্ষণ আইনে এমন কার্যক্রম সম্পূর্ণভাবে অবৈধ এবং দন্ডবিধিযুক্ত অপরাধ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রখ্যাত পাখি বিশেষজ্ঞ ইনাম আল হক বলেন, আমাদের দেশে প্রায় ৭ রকমের টিয়া রয়েছে। চন্দনা টিয়া, বাসন্তী লটকন টিয়া, মদন টিয়া, লালমাথা টিয়া, মেটেমাথা টিয়া, ফুলমাথা টিয়া ও সবুজ টিয়া। এরা সাধারণত বন, বৃক্ষবহুল এলাকা, প্রশস্ত পাতার বন, আর্দ্র পাতাঝরা বন, খোলা বন, পাহাড়ি বন, বসতবাড়ির বৃহৎ বৃক্ষ, আবাদি জমি, পুরোনো বাড়িতে বসবাস ও বিচরণ করে।
সাত প্রজাতির মধ্যে সবুজ টিয়ার সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। সবুজ টিয়া কলাপাতা-সবুজ রঙের সুদর্শন পাখি। দেহের দৈর্ঘ্য সাধারণত ৪২ সেন্টিমিটার, ওজন ১৩০ গ্রাম। সামান্য কিছু পালক ছাড়া পুরো দেহই সবুজ। দীর্ঘ সবুজ লেজের নিচের দিকে নীলের আমেজ পাখিটাকে আরও সৌন্দর্যময় করে তুলেছে। এরা সারা দেশেই আছে, সহজে দেখা মেলে। ঠোঁট মিষ্টি লাল, চোখ হলদে-সাদা। ছেলেপাখির থুতনিতে কালো রেখা, গলা ও ঘাড়ের পেছনে গোলাপি পাটল বর্ণ। মেয়েপাখির ঘাড় পান্না সবুজে ঘেরা।
সবুজ টিয়া সচরাচর ছোট দলে থাকে, তবে জোড়ায়ও দেখা যায়। খাদ্য তালিকায় আছে পত্রগুচ্ছ, ফুল, ফল, লতাপাতা, বীজ ও ফলের মিষ্টি রস। গ্রামের ধান ক্ষেতে সবুজ টিয়ারা নামে পাকা ধান খেতে। নদীর ধার দিয়ে শেষ বিকেল ও গোধূলিলগ্নে দল বেঁধে উড়ন্ত টিয়াদের দৃশ্য এক মনোরম মনকাড়া সৌর্ন্দের প্রতিচ্ছবি।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মনিরুল এইচ খান জানান, টিয়া পাখি বিলুপ্ত হচ্ছে শিকারীদের হাতে। গবেষকদের মতে, শুধু শিকারীদের লোলুপদৃষ্টিই পাখি ধ্বংসের একমাত্র কারণ নয়। জীববৈচিত্র্য ধ্বংসও অন্যতম কারণ। জানুয়ারি থেকে এপ্রিল হলো টিয়া পাখির প্রজননের সময়। বাসা বাঁধে গাছের প্রাকৃতিক কোটরে। এই পাখি বছরে ২ থেকে ৪টি ডিম দেয়। আর ডিম ফোটতে সময় লাগে ২২ থেকে ২৪ দিন। একটি শাবক টিয়া স্বাধীনভাবে চলাচলের জন্য সময় নেয় ৫০ থেকে ৫৫ দিন।
তাদের খাদ্য তালিকায় রয়েছে ফুল, ফুলের রস, ফল, লতাপাতা, বীজ প্রভৃতি। নীরব গাছের ডালে অন্যপাখিদের সঙ্গে রাত কাটায়।
বিলুপ্ত হয়ে পড়া এ পাখিটি বিশেষ করে ফল এবং বীজজাতীয় শস্য খেতের আশপাশে বেশি নজরে পড়ে। ঝাঁকবেঁধে শস্য খেতে বিচরণ করার কারণে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি করে এরা। যা খায় তার চেয়ে বেশি অপচয় করে। কৃষকদের সঙ্গে এদের বৈরিতার কারণ ফসল নষ্ট করা নিয়ে। মাঝে মধ্যে এদের একাকী কিংবা জোড়ায় জোড়ায়ও বিচরণ করতে দেখা যায়। কণ্ঠস্বর কর্কশ।
কয়েক দশক আগে দেশের বিভিন্ন স্থানে এ প্রজাতিটির সাক্ষাৎ পাওয়া গেলেও ইদানিং যত্রতত্র নজরে পড়ে না। খাঁচায় বন্দী এবং উঁচু গাছ-গাছালির সংকটের কারণে এদের প্রজননে বিঘ্ন ঘটছে। ফলে প্রজাতিটি দেশে ‘মহাবিপন্ন’ হয়ে পড়েছে। এদের বৈশ্বিক বিস্তৃতি ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, নেপাল, ভুটান, থাইল্যান্ড, লাওস, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, মিয়ানমার পর্যন্ত। অত্রাঞ্চলে এই পাখিগুলো ভালো অবস্থানে রয়েছে।
এদের নিরাপদ আবাসস্থল আর শিকারীদের তৎপরতা বন্ধ না করলে এক সময় বিলুপ্তির খাতায় নাম উঠবে প্রকৃতির অপরূপ শোভা টিয়া পাখির। তাই টিয়া পাখি রক্ষায় সকলের সজাগ দৃষ্টি ও আন্তরিকতার খুব বেশি প্রয়োজন বলে মনে করছেন পরিবেশবাদীরা।
সম্পাদক ও প্রকাশকঃ মোঃ মুরসিদ আহমেদ সিকদার, মোবাইল : 01728 311111
ঢাকা অফিসঃ হোল্ডিং-১৩, লাইন-৬, রোড- ১২, ব্লক-বি, মিরপুর-১১, ঢাকা-১২১৬
ফরিদপুর অফিসঃ মুজিব সড়ক, ফরিদপুর, ই-মেইলঃ [email protected]
Copyright © August, 2020-2025 @ Daily Somoyer Protyasha