প্রয়াত কূটনীতিবিদ ফারুক চৌধুরী তার আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘জীবনের বালুকাবেলায়’ লিখেছেন, ‘অকস্মাৎ আলোচনা কক্ষের দরজাটা সশব্দে খুললেন মানি দীক্ষিত (জে এন দীক্ষিত, ভারতের বিদেশ মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তা, পরবর্তীকালে নিরাপত্তা উপদেষ্টা)। এই মাত্র খবর এসেছে শেখ মুজিব মুক্তি পেয়েছেন।
খবর তিনি ইতোমধ্যে পাকিস্তান ত্যাগ করেছেন। ভেঙে গেল বৈঠক, সম্মেলনকক্ষটি ভেঙে পড়ল স্বতঃস্ফূর্ত করতালিতে। ’অতঃপর সারা বিশ্বের কূটনৈতিক ইতিহাসের সেরা বিস্ময়কর ঘটনাটি ঘটে গেছে। গান্ধী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখনই ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী এবং তখনকার মহামান্য রাষ্ট্রপতি একইসঙ্গে গেলেন বঙ্গবন্ধুকে ফুলেল শুভেচ্ছা দিতে। বিশ্বের আর কোনো নেতা এখন অব্দি একইসঙ্গে একটি রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির উষ্ণ অভ্যর্থনায় সিক্ত হননি। তার চাইতেও বড় কথা ভারতের মানুষের কাছে বঙ্গবন্ধু ততদিনে একজন সুপার হিরো বনে গেছেন।
ভারত ত্যাগের আগে এক বক্তব্য শুরু করতেই যখন মুজিব ইংরেজি বলা শুরু করলেন, ‘লেডিস অ্যান্ড জেন্টেল ম্যান…’, তখনই উচ্চসরে উপস্থিত সাধারণ জনতা বলা শুরু করলো ‘নো মুজিব, নো মুজিব, বাংলা! বাংলা!’ তারা বঙ্গবন্ধুকে কোনো দিন দেখে নাই, বাংলা বুঝেও না তবুও তাদের মুখে একটুখানি বাংলা শুনার প্রয়াসকে উপভোগ করতে সবাই উদগ্রীব। একজন নেতার এটার চেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কী হতে পারে!
১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধে শোচনীয় পরাজয় বরণ করে পাকিস্তান সরকার, প্রবল আন্তর্জাতিক চাপ ও বাংলাদেশের মাটিতে আত্মসমর্পণ করা পাকিস্তানি সৈন্যদের নিরাপদে স্বদেশে ফিরিয়ে নেওয়ার তাগিদে বঙ্গবন্ধুকে তার স্বদেশে ফিরিয়ে দিতে সিদ্ধান্তে পৌঁছায়। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান থেকে মুক্তি পান ১৯৭২ সালের ৭ জানুয়ারি ভোর রাতে ইংরেজি হিসেবে ৮ জানুয়ারি। এদিন বঙ্গবন্ধুকে বিমানে তুলে দেওয়া হয়। সকাল সাড়ে ৬টায় তিনি লন্ডনের হিথরো বিমানবন্দরে পৌঁছান। বেলা ১০টার পর থেকে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ, তাজউদ্দিন আহমদ ও ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীসহ অনেকের সঙ্গে তিনি কথা বলেন। পরে ব্রিটেনের বিমান বাহিনীর একটি বিমানে করে পরের দিন ৯ জানুয়ারি দেশের পথে যাত্রা করেন। ১০ তারিখ সকালেই বঙ্গবন্ধু ভারতের দিল্লিতে নামেন। সেখানে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের জনক শেখ মুজিবুর রহমান ভারতের রাষ্ট্রপতি ভিভি গিরি, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, সমগ্র মন্ত্রিসভা, প্রধান নেতারা, তিন বাহিনীর প্রধান এবং অন্যান্য অতিথি ও সে দেশের জনগণের কাছ থেকে উষ্ণ সংবর্ধনা লাভ করেন।
আজ সেই ১০ জানুয়ারি। বাংলার ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় দিন। আজ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস। ১৯৭২ সালের এদিন বেলা ১টা ৪১ মিনিটে পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তিলাভ করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখেন।
আজকের এ ঘটনা ছিল বাংলাদেশ জন্মের ইতিহাসের আরেক আশীর্বাদ এবং বিজয়গাঁথা। অন্ধকার হতে আলোয় যাত্রা। ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয়ের পরই বাঙালি জাতি বঙ্গবন্ধুকে প্রাণঢালা সংবর্ধনা জানানোর জন্য অধীর অপেক্ষায় ছিল। আনন্দে আত্মহারা লাখ লাখ মানুষ ঢাকা বিমানবন্দর থেকে রেসকোর্স ময়দান পর্যন্ত তাকে স্বতঃস্ফূর্ত সংবর্ধনা জানায়। স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, যিনি পাকিস্তানের ২৩ বছরের শাসনামলে হয়ে উঠেছিলেন বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা।
পাকিস্তানের শাসনামলের ২৩ বছরের ১৩ বছর তিনি পাকিস্তানের কারাগারে কাটিয়েছেন, দুইবার মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছেন। তার একমাত্র অপরাধ তিনি আজীবন পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী বাংলা ও বাঙালির বিরুদ্ধে যে আচরণ করেছে তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেন, পাকিস্তানের সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্রের বৈষম্যমূলক শাসনের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার গোড়ার ইতিহাসে ফিরে গেলে এটা তো এখন পরিষ্কার, পাকিস্তান সৃষ্টির পেছনে প্রধান উদ্দেশ্য ছিল উত্তর ভারত, পাঞ্জাবের এলিট শ্রেণি ও সেখানকার ভূস্বামীদের স্বার্থ রক্ষা করা। ভারতের মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষা হয়ে উঠেছিল গৌণ।
১৯৭১ সালের ১০ জানুয়ারি অবসান ঘটে জাতির দীর্ঘ প্রতীক্ষার। দিল্লী থেকে বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী ব্রিটিশি রাজকীয় বিমান বাহিনীর কমেট বিমানটি ঢাকার আকাশ সীমায় দেখা দিতেই জনসমুদ্র উদ্বেলিত হয়ে ওঠে। দুপুর ১টা ৫১ মিনিটে ঢাকা বিমানবন্দরে বিমানটি অবতরণ করে। বিমানে সিঁড়ি স্থাপনের সঙ্গে সঙ্গে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ও অন্যান্য নেতারা, মুজিব বাহিনীর চার প্রধান, কেন্দ্রীয় স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতারাসহ ছুটে যান বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানাতে। সে এক অবিস্মরণীয় ক্ষণ, অভূতপূর্ব মুহূর্ত।
বিমানের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু জনতার মহাসমুদ্রের উদ্দেশে হাত নাড়েন। তার চোখে তখন স্বজন হারানোর বেদনা-ভারাক্রান্ত অশ্রুর নদী, আর জ্যোতির্ময় দ্যুতি ছড়ানো মুখাবয়ব জুড়ে বিজয়ী বীরের পরিতৃপ্তির হাসি। বিমানের সিঁড়ি বেয়ে জাতির জনক তার স্বপ্নের সোনার বাংলায় পদার্পণের সঙ্গে সঙ্গে একত্রিশবার তোপধ্বনি করে রাষ্ট্রপ্রধানের প্রতি সম্মান জানানো হয়। এরপর বঙ্গবন্ধুকে মঞ্চের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়। চারদিক থেকে তার উপর পুষ্পবৃষ্টি হতে থাকে। বাংলাদেশ সেনা, বিমান ও নৌবাহিনী রাষ্ট্রপ্রধানকে গার্ড অব অনার দেয়। মঞ্চ থেকে বঙ্গবন্ধু সালাম গ্রহণ করেন। এসময় বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি কর্নেল আতাউল গণী ওসমানী, লে. কর্নেল শফিউল্লাহ্ এবং বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ পুত্র লেফটেন্যান্ট শেখ কামাল জাতির জনকের পাশে ছিলেন।
গার্ড অব অনার পরিদর্শনের পর বঙ্গবন্ধু বিমান বন্দরে উপস্থিত রাজনৈতিক নেতারা, ঢাকাস্থ বিদেশি মিশনের সদস্যরা, মিত্র বাহিনীর পদস্থ সামরিক অফিসার, বাংলাদেশ সরকারের পদস্থ কর্মকর্তা, আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতারা এবং অন্যান্য বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে করমর্দন করেন।
তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে সেদিন চারদিকে লক্ষ লক্ষ অপেক্ষমান জনতা, কোনদিকে তিল ধারণের ঠাঁই নেই। আবাল-বৃদ্ধ-বণিতার মুহূর্মুহূ করতালিতে চারদিক মুখরিত। ‘জয় বাংলা’, ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ রণধ্বনিতে সবকিছু যেন ডুবে গেল। উন্নত ললাট, প্রশান্ত বদন, দু চোখ তখনও অশ্রুসিক্ত, কণ্ঠ বাষ্পরুদ্ধ। সে অবস্থায়ই চিরাচরিত ভঙ্গিতে ‘ভাইয়েরা আমার’ বলে উপস্থিত জনসমুদ্রের উদ্দেশে নিবেদন করলেন তার ঐতিহাসিক বক্তৃতা।
বঙ্গবন্ধুর ভাষণে সেদিন সবাইকে দেশ গড়ার ডাক দেন। সে ভাষণটি হচ্ছে নতুন দেশ পুনর্গঠনের নির্দেশনা ও ভবিষ্যত বাংলাদেশের রূপরেখা। পূর্বপ্রস্তুতিহীন এ সংক্ষিপ্ত ভাষণে অনেক বিষয়ের প্রতি বঙ্গবন্ধু দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। যা রাষ্ট্র ও জাতি গঠনে তাৎপর্য বহন করে। পাশাপাশি বহন করে বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্রনায়কোচিত দূরদৃষ্টির। ভাষণটি ছিল সংক্ষিপ্ত। এ সংক্ষিপ্ত ভাষণেই বাঙালী জাতি ও ভবিষ্যত বাংলাদেশ গড়ার প্রক্রিয়া সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা দিতে সক্ষম হন বঙ্গবন্ধু।
বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে দেশের উন্নয়নের জন্য ডাক দিলেন এভাবে-‘যথেষ্ট কাজ পড়ে রয়েছে। আপনারা জানেন, আমি সমস্ত জনগণকে চাই, যেখানে রাস্তা ভেঙ্গে গেছে, নিজেরা রাস্তা করতে শুরু করে দেও। আমি চাই জমিতে যাও, ধান বোনাও, কর্মচারীদের বলে দেবার চাই, একজন ঘুষ খাবেন না, আমি ক্ষমা করব না। ’
রেসকোর্সের জনসভায় তিনি মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে শিশুর মতো কান্নায় ভেঙে পড়েন। ভাষণে কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘বিশ্বকবি তুমি বলেছিলে ‘সাত কোটি সন্তানের হে মুগ্ধ জননী, রেখেছ বাঙালি করে মানুষ করনি। ’ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ তুমি দেখে যাও, তোমার আক্ষেপকে আমরা মোচন করেছি। তোমার কথা মিথ্যা প্রমাণিত করে আজ ৭ কোটি বাঙালী যুদ্ধ করে রক্ত দিয়ে এই দেশ স্বাধীন করেছে। হে বিশ্বকবি তুমি আজ জীবিত থাকলে বাঙালির বীরত্বে মুগ্ধ হয়ে নতুন কবিতা সৃষ্টি করতে। ’
বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন বাঙালি জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামের আরেকটি আলোকিত অধ্যায়। প্রকৃতপক্ষে ১০ জানুয়ারিতে বাংলার রাজনীতির মুকুটহীন সম্রাট সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে পেয়ে বাঙালী বিজয়ের পরিপূর্ণ আনন্দ প্রাণভরে উপভোগ করেছে। এ দিনই বঙ্গবন্ধুর হাত ধরেই স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রবেশ করে গণতন্ত্রের এক আলোকিত অভিযাত্রায়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এবং বাংলাদেশ একাত্ম হয়ে আছে একসূত্রে। যত দিন বাংলাদেশ থাকবে সেই অনন্তকাল পর্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হবে বঙ্গবন্ধুর নাম।
এন আই আহমেদ সৈকত
উপ- তথ্য, যোগাযোগ ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক,
বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ।