কর্মসূচি ঘিরে ঢাকা ও দেশের বিভিন্ন স্থানে বিএনপি নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তারের অভিযোগ পাওয়া গেছে। তবে পুলিশ বলেছে, আগের মামলার আসামিদের গ্রেপ্তার করছে তারা।
রাজপথে মহাসমাবেশ করলে আওয়ামী লীগও রাজপথে শান্তি সমাবেশ করবে। এমন অঘোষিত এক দাবি ওঠায় জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল আওয়ামী লীগের সহযোগী ও বিএনপির পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি ঘিরে। তবে আওয়ামী লীগ মাঠে যেতে রাজি যদি বিএনপিও মাঠে সমাবেশ করে, সে শর্তে। সমাবেশ স্থান নিয়ে জটিল এ পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে গতকাল বৃহস্পতিবারের সমাবেশের দিন পিছিয়ে যায়।
আগে ঘোষণা দেওয়া বৃহস্পতিবার মহাসমাবেশ করার জন্য বিএনপি অনুমতি চেয়ে বুধবার পুলিশের সঙ্গে দেনদরবার, নিজেদের মধ্যে দফায় দফায় বৈঠক করে। বিএনপিকে নয়াপল্টনের পরিবর্তে গোলাপবাগ মাঠে সমাবেশ করার বিকল্প দিয়ে পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়, কর্মদিবসে করলে সেই মাঠেই করতে হবে। অন্যথায় ছুটির দিনে করতে হবে। রাত পর্যন্ত এ নিয়ে দরকষাকষি করে শেষে বিএনপি কর্মসূচি পিছিয়ে শুক্রবার করার সিদ্ধান্ত নেয়।
একইদিন বৃহস্পতিবার আওয়ামী লীগের তিন সংগঠন যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও ছাত্রলীগ তারুণ্যের জয়যাত্রা সমাবেশের ঘোষণা দেয়। এর আগে যুবলীগের সমাবেশ থেকে বলা হয়েছিল, তারা ২৪ জুলাই সমাবেশ করবে। কিন্তু পিছিয়ে বিএনপির মহাসমাবেশের দিন করায় এ নিয়ে এক ধরনের উত্তেজনা তৈরি হয়। বিএনপি সংঘাতের উসকানি দেওয়ার জন্য আওয়ামী লীগকে দায়ী করে। তবে আওয়ামী লীগের পক্ষ সংঘাতের আশঙ্কা নাকচ করে দিয়ে উল্টো বিএনপির বিরুদ্ধে দেশের অস্থিতিশীলতা তৈরির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনে।
বিএনপি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের এক দফা দাবিতে মহাসমাবেশ করবে নয়াপল্টনের দলীয় কার্যালয়ের সামনের সড়কে। অন্যদিকে শান্তি ও উন্নয়ন প্রচারে সমাবেশ করবে টানা তিনবার ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের তিন সংগঠন।
ডিএমপির অনুমতি নিয়ে সমাবেশ স্থান জটিলতা দূর হলেও আওয়ামী লীগ ও বিএনপির পাল্টাপাল্টি অবস্থান ও কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ও অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। বিএনপি মহাসমাবেশ শেষে রাস্তায় বসে যেতে পারে গোয়েন্দা সংস্থার এমন তথ্যের বরাত দিয়ে প্রকাশিত খবরে ভাবিয়ে তুলেছে আওয়ামী লীগকে। বিএনপি এমন কোনো পরিস্থিতির দিকে গেলে কী করবে আওয়ামী লীগ, সে সিদ্ধান্ত ও প্রস্তুতি মাথায় রেখে এগোতে হচ্ছে ক্ষমতাসীন দলকে। তবে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায় মনে করে, বিএনপি বসে যাওয়ার মতো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে না। করলে সেই প্রস্তুতি নিয়ে রাখা হয়েছে।
এ ছাড়া বিএনপির বসে পড়ার বিষয়টি মাথায় রেখে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও দফায় দফায় বৈঠক করছে। সতর্ক নজর রেখেছে বিএনপির কর্মসূচি ঘিরে।
নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে মহাসমাবেশ করার শেষ প্রস্তুতি গ্রহণ করছে বিএনপি। মহাসমাবেশ সফল করতে সার্বিক প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে বলে গতকাল গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন দলটির নেতারা। এ ছাড়া সরকারবিরোধী বিএনপির সমমনা দলগুলো গণমাধ্যমে পাঠানো বিবৃতিতে পৃথক পৃথক স্থানে সমাবেশ করার কথা জানিয়েছে।
বিকেলে নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেন, ‘আমরা শান্তিপূর্ণভাবে শুক্রবারের সমাবেশের কর্মসূচি পালন করব। আশা করি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ইতিমধ্যে যাদের গ্রেপ্তার করেছে তাদের মুক্তি দেবে এবং সমাবেশে যোগ দিতে আসা নেতাকর্মীদের কোনো ধরনের বাধা দেবে না।’
দুপুরে নয়াপল্টনের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ বলেছেন, ‘কর্মসূচিকে সামনে রেখে বাসাবাড়ি, হোটেলসহ বিভিন্ন জায়গায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা অভিযান চালিয়ে দলের পাঁচ শতাধিক নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে। কর্মসূচি ঘোষণা হলেই ধরপাকড় উদ্বেগের বিষয়।’
বিএনপি ও গণতন্ত্র মঞ্চ সূত্রে জানা গেছে, মহাসমাবেশ থেকে টানা কর্মসূচি দেওয়ার চিন্তা আছে বিএনপি ও সমমনাদের। ১০ আগস্ট পর্যন্ত বিক্ষোভ সমাবেশ, অবস্থান, ঘেরাওয়ের মতো কর্মসূচি দিতে পারে দলগুলো। ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসের কারণে কর্মসূচি সাময়িক স্থগিত করে ২০ তারিখ থেকে আবার লাগাতার আন্দোলনে যাবে দলগুলো। তবে শরিকরা বিএনপিকে আলটিমেটাম দেওয়ার পরামর্শ দিলেও গত দুদিনের পরিস্থিতি দেখে সেটা নাও দেওয়া হতে পারে।
গণতন্ত্র মঞ্চের শরিক বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক গণমাধ্যমকে বলেন, ‘সমাবেশ থেকে আমরা সর্বাত্মক আন্দোলনের ঘোষণা দেব।’
দিনভর নয়াপল্টনে যা ঘটেছে : গত বুধবার সন্ধ্যার পর থেকে নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে বিপুলসংখ্যক পুলিশ জলকামান ও এপিসি নিয়ে অবস্থান নেয়। দলের শীর্ষ নেতাদের নির্দেশনা মেনে নেতাকর্মীরা কার্যালয় ছেড়ে চলে যান। এরপর গতকাল সকালে কার্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে অবস্থান নেয় পুলিশ। এ ছাড়া কার্যালয়ের পাশে প্রধান সড়কের ওপর অবস্থান নেয়। প্রধান সড়কের পাশাপাশি সেখানকার একটি গলিতেও অসংখ্য পুলিশ সদস্যকে অবস্থান করতে দেখা যায়। এ ছাড়া একটি রায়ট কার (এপিসি), জলকামান ও প্রিজনভ্যানও বিএনপি অফিসের সামনে দেখা যায়। সেখানে দায়িত্বরত পল্টন থানার উপপরিদর্শক (এসআই) টিটো বলেন, কোনো ধরনের অপ্রীতিকর এবং আইনশৃঙ্খলার অবনতি যাতে না ঘটে, সেজন্য তারা সতর্ক অবস্থানে রয়েছেন।
এ সময় কার্যালয়ের সামনে দলটির বেশ কিছু নেতাকর্মীকে দেখা গেছে। তবে দলীয় কার্যালয়ের সামনে নেতাকর্মীরা জড়ো হতে দেখলেই পুলিশ তাদের সরিয়ে দিচ্ছিল। পরে জ্যেষ্ঠ নেতারা এসে কার্যালয়ের সামনে থাকা নেতাকর্মীদের চলে যেতে বলেন।
নয়াপল্টনে সমাবেশের ঘোষণা বিএনপির : এর আগে গত বুধবার রাতে গুলশানে দলের চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে স্থায়ী কমিটির এক ভার্চুয়াল সভা হয়। সভা শেষে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘পুলিশের অনুরোধ ও জনগণের ভোগান্তির কথা বিবেচনায় নিয়ে আমরা আমাদের সমাবেশ বৃহস্পতিবারের পরিবর্তে শুক্রবার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আশা করছি পুলিশ আমাদের নয়াপল্টনে কার্যালয়ের সামনে সমাবেশ করতে দেবে।’
শান্তি ও উন্নয়ন সমাবেশ : একইদিন শান্তি ও উন্নয়ন প্রচারের সমাবেশের প্রস্তুতি নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করেছেন আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও ছাত্রলীগের নেতারা। সমাবেশস্থলের মঞ্চ, মাইক ও সাজসজ্জার কাজ করেছে আয়োজক তিন সংগঠন। ঢাকার আশপাশের জেলা-উপজেলা থেকে নেতাকর্মীর সমাবেশে আনতে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। শান্তি সমাবেশের প্রস্তুতির পাশাপাশি বিএনপির মহাসমাবেশ নিয়েও সতর্ক অবস্থানে রয়েছে ক্ষমতাসীনরা।
বিএনপির নেতাকর্মীরা ঢাকায় বসে যেতে পারে এমন খবর প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় বিভিন্ন পদে থাকা ছয় নেতা গণমাধ্যমকে বলেন, এমন কোনো তথ্য নেই তাদের কাছে। তাদের প্রত্যাশা, ১০ ডিসেম্বরের মতো এবারও কর্মসূচি নিয়ে নির্বিঘ্নে ফিরে যাবে বিএনপি। অন্য কোনো পথে গেলে হেফাজতের মতো বিদায় করার প্রস্তুতি আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদেরও আছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীরও আছে।
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য কাজী জাফর উল্যাহ বলেন, ‘বিএনপি যদি অবস্থান কর্মসূচি দেয়, তাহলে আমাদের কিছু করণীয় নেই। সেটা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দেখবে। তাদের (আইনশৃঙ্খলা বাহিনী) যদি কোনো সহায়তার দরকার হয়, তাহলে আমাদের কর্মসূচি থেকে নেতাকর্মীরা সহায়তা করবে।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্য বলেন, ২০১৩ সালের ৫ মে সমাবেশের নামে শাপলা চত্বরে অবস্থান করে তা-ব চালিয়েছিল হেফাজতে ইসলাম। কিন্তু সেদিন সরকার তাদের কঠোর হস্তে দমন করে রাতের মধ্যে ঢাকা খালি করতে সক্ষম হয়েছে। এখন বিএনপি যদি সমাবেশের নামে ঢাকায় অবস্থান নিতে চায়, তাহলে তাদের অবস্থা হবে হেফাজতের মতো।
দলটির সভাপতিমন্ডলীর আরেক সদস্য ফারুক খান বলেন, ‘বিএনপি কী করবে, সেটা তো আমরা জানি না। তারা যদি আইনশৃঙ্খলা বিপন্ন করার চেষ্টা করে, মানুষের যাতায়াত ও জনজীবন ব্যাহত করার পাঁয়তারা করে, সে ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আইনানুগ ব্যবস্থা নেবে।’
পুলিশের ২৩ শর্ত : গতকাল ডিএমডির মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ সমাবেশের অনুমতির কথা জানান ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক। তিনি বলেন, দুই দলকে ২৩টি শর্তে সমাবেশে অনুমতি দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি দলগুলোর আবেদন অনুযায়ী পছন্দের স্থানে সমাবেশ আয়োজন করতে পারবে।
ডিএমপি কমিশনার বলেন, বিএনপি কাকরাইলের নাইটিঙ্গেল মোড় থেকে রাজারবাগ মোড় পর্যন্ত সমাবেশ করতে পারবে। আর আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনগুলো বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেট থেকে মহানগর নাট্যমঞ্চ পর্যন্ত সমাবেশ করবে। এ সীমানার মধ্যেই মাইক স্থাপন করতে পারবে তারা। সমাবেশে ব্যাগ ও লাঠিসোঁটা নিয়ে আসা যাবে না। সমাবেশে শর্তগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে রাষ্ট্রবিরোধী কোনো বক্তব্য দেওয়া যাবে না।
ডিএমপির শর্তের মধ্যে আরও আছে, নিরাপত্তার জন্য নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় স্বেচ্ছাসেবক (দৃশ্যমান আইডি কার্ডসহ) নিয়োগ করতে হবে। সমাবেশস্থলে চারদিকে সিসি ক্যামেরা স্থাপন করতে হবে। সমাবেশে আগতদের মেটাল ডিটেক্টরের মাধ্যমে (ভদ্রোচিতভাবে) চেকিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে, শব্দদূষণ রোধে সীমিত আকারে মাইক ব্যবহার করতে হবে। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত আসতে পারে এমন ব্যঙ্গচিত্র প্রদর্শন, বক্তব্য প্রদান বা প্রচার করা যাবে না।
বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তারের বিষয়ে ডিএমপি কমিশনার বলেন, ‘এ ধরনের কোনো ঘটনা আমার জানা নেই। ডিএমপির কোনো কর্মকর্তা জড়িত থাকলে তদন্ত করে অবশ্যই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আমরা নিয়মিত অভিযানের অংশ হিসেবে মামলার আসামি গ্রেপ্তার করছি।’