ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলার ময়না ইউনিয়নের মাধবপুরে দুগ্ধ উৎপাদন সমবায় সমিতির সদস্যদের নামে গৃহিত ঋণের কোটি টাকা আত্মসাত হতে চলেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। প্রকল্পের মেয়াদ এবং ২% সার্ভিস চার্জসহ ঋণ পরিশোধের সময় শেষ হলেও কোটি টাকার ওপরে অনাদায়ী। ওই সমিতির সভাপতি যুবলীগ নেতা একাই ৫৪জনের নামে ৫৯ লাখ ৪০ হাজার টাকা তুলে নিয়েছেন বলে জানা গেছে। টাকা তুলতে লাল নোটিশ ইস্যু করেছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, “দুগ্ধ সমবায় সমিতির কার্যক্রম বিস্তৃতকরণের মাধ্যমে বৃহত্তর ফরিদপুর বরিশাল ও খুলনা জেলার দারিদ হ্রাসকরণ ও আর্থসামাজিক উন্নয়ন প্রকল্পের” আওতায় ২০১৫ সালে “মাধবপুর প্রাথমিক দুগ্ধ উৎপাদনকারী সমবায় সমিতি” গঠন করে ১২৫জন সদস্যকে এক কোটি ৩৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা ঋণ দেওয়া হয়। সদস্য প্রতি ঋণের পরিমান এক লাখ দশ হাজার টাকা।
জনতা ব্যাংক বোয়ালমারী শাখার মাধ্যমে ঋণের টাকা দেওয়া হয়। ২০১৫ সালের ১৪ ডিসেম্বর থেকে ঋণ দেওয়া শুরু হয়। ২০১৭ সালের জুন মাসে প্রকল্পের মেয়াদ এবং দশ মাস গ্রেস টাইমসহ পরবর্তি ৩৬ মাস বা ৩ বছরে ঋণ পরিশোধের মেয়াদ শেষ হলেও আদায় হয়েছে যৎসামান্য টাকা। হিসাব অনুযায়ী ২০১৯ সালের নভেম্বও মাসের মধ্যে সব টাকা পরিশোধ হওয়ার কথা। সেখানে ২০২০ সালের ০৫ নভেম্বর পর্যন্ত আদায় হয়েছে মাত্র ২৬ লাখ ৬৮ হাজার ১২৪ টাকা। অনাদায়ী রয়েছে এক কোটি দশ লাখ ৮১ হাজার ৮৭৬ টাকা। চক্রবৃদ্ধিহারে ২% সার্ভিস চার্জতো রয়েছেই।
বোয়ালমারী উপজেলা সমবায় অফিসে এ বিষয়ে তেমন কোন কাগজপত্র না পাওয়া গেলেও যতদূর জানা গেছে, নীতিমালা অনুযায়ী নিজস্ব গোয়াল ঘর, ঘাস লাগানোর জমি, ১৮ বছরের ওপরে বয়স, ওই এলাকার স্থায়ী বাসিন্দা হতে হবে বলে শর্ত ছিল কিন্তু নীতিমালা ও শর্ত না মেনেইে অনেককে ঋণ দেওয়া হয়েছে। জামানত হিসেবে গ্রাহকের একটি চেক এবং চুক্তিপত্র।
যে চুক্তিপত্রে উপজেলা সমবায় অফিসার ও সমিতির সভাপতি স্বাক্ষর করেছিলেন। তৎকালীন সময়ের সমবায় কর্মকর্তা মোহাম্মদ আলাউদ্দিন মোল্যা পাশের মধুখালী উপজেলার সমবায় অফিসার হিসেবে পদায়ন থাকলেও বর্তমানে তিনি প্রেষণে ঢাকার প্রধান কার্যালয়ে কর্মরত আছেন।
অভিযোগ রয়েছে ওই সময় সমবায় অফিসার ও সমিতির সভাপতি জিয়াউর রহমান লিংকনের যোগসাজসে নানা রকম অনিয়ম করা হয়েছে। খাতা কলমে নাম থাকলেও ৫৪জনের টাকা চলে যায় ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি জিয়াউর রহমান লিংকনের কাছে। বয়স না হলেও মো. জিয়াউর রহমানের মেয়ে মোসা. লিমার নামে ঋণ দেওয়া হয়েছে।
মো. মারশিউল হক সুমন, মো. শিবলি সাদিক শিফাত, মোছা. তুলি বেগমের ঠিকানা মাধবপুর দেখানো হলেও তাদের বাড়ি মাগুরা জেলার মহম্মদপুর উপজেলায় বলে জানা গেছে। লিংকন প্রভাবশালী হওয়ায় ওই এলাকার কেউ তার বিরুদ্ধে মুখ খুলতে চায়না। টাকা আদায় না হওয়ায় সমবায় অধিদপ্তরের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা লাল নোটিশ জারি করার সিদ্ধান্ত নেন। সে হিসেবে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ঝোটন চন্দ গত ২৪ সেপ্টেম্বর লাল নোটিশ ইস্যু করেন। কিন্তু এই লাল নোটিশ সবাইকে দেওয়া হচ্ছে না।
উপজেলা সমবায় অফিসার মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, কমপক্ষে ৮০জনের নামে লাল নোটিশ ইস্যু করা হয়েছে তবে এ পর্যন্ত ৬জনকে নোটিশ দেওয়া হয়েছে। প্রথম চারজনকে নোটিশ দেওয়ার পরে কিছু কিছু টাকা আদায় হচ্ছে। নোটিশ জারির কথা বলে টাকা আদায়ের চেষ্টা করা হচ্ছে। টাকা তুলতে না পারলে নোটিশ প্রদানসহ আইনি প্রক্রিয়ায় যাওয় হবে।
তিনি আরও বলেন, সমিতির সভাপতি একাই ৫৪জনের টাকা নিয়ে নিয়েছিলেন। তবে তিনি ৪৮জনের টাকা ফেরত দেওয়ার দায়িত্ব নিয়েছেন। উপজেলা সমবায় অফিসে তথ উপাত্ত আনতে গেলে সমবায় অফিসার বলেন, এই অফিসে তেমন কোন কাগজপত্র সংরক্ষিত নেই। তখনকার সমবায় অফিসার কাগজপত্র নিয়ে গেছেন। তার যোগসাজসে তখন ঋণ বিতরণে অনিয়ম হয়েছে বলে মনে করেন সমবায় অফিসার মো. সিরাজুল ইসলাম।
“মাধবপুর প্রাথমিক দুগ্ধ উৎপাদনকারী সমবায় সমিতির” সভাপতি ও ময়না ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি মো. জিয়াউর রহমান লিংকন সব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, তিনি কোন গ্রাহকের টাকা নেননি। প্রত্যেক গ্রাহকের নামে প্রথকভাবে চেক হয়েছে, প্রত্যেকে জনতা ব্যাংকে চেক জমা দিয়ে টাকা তুলেছেন।
তিনি তার পরিবারের (নিজ, স্ত্রী, মেয়ে, মা, ভাই, বোন) নামে নেওয়া ঋণের টাকা ফেরত দিচ্ছেন না কেন জানতে চাইলে বলেন, করোনার কারণে একটু ঝামেলা হয়ে গেছে। এখন টাকা উঠে যাবে। সমিতির সভাপতি হিসেবে তিনি গ্রাহকদের নিকট থেকে টাকা তোলার ব্যাপরে সহযোগিতা করছেন বলে দাবি করেন। সবশেষ তিনি চা খাওয়ার দাওয়াত দিয়ে এ বিষয়ে রিপোর্ট না করার অনুরোধ করেন।
এ বিষয়ে “দুগ্ধ সমবায় সমিতির কার্যক্রম বিস্তৃতকরণের মাধ্যমে বৃহত্তর ফরিদপুর বরিশাল ও খুলনা জেলার দারিদহ্রাসকরণ ও আর্থসামাজিক উন্নয়ন প্রকল্পের” প্রকল্প পরিচালক মো. আসাদুজ্জামান জানান, ফরিদপুর জেলার ফরিদপুর সদর, বোয়ালমারী, গোপালগঞ্জের টুঙ্গীপাড়া, গোপালগঞ্জ সদর, খুলনার ডুমুরিয়াসহ ২২টি উপজেলায় এ প্রকল্প চালু করা হয়েছিল। সব প্রকল্পগুলো সঠিকভাবে পরিচালিত হলেও বোয়ালমারীতেই সমস্যা শুরু হয়।
এ প্রকল্পের টাকাটা সময়মত আদায় করা যাচ্ছে না। তখনকার ম্যানেজমেন্ট দুর্বল থাকার কারণে হয়তো এ সমস্যগুলো সৃষ্টি হয়েছে। তবে বর্তমান জেলা ও উপজেলা সমবায় অফিসার দক্ষ ও ভাল কর্মকর্তা। তাঁরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। না হলে, ঋণ গ্রহীতাদের চেক দেওয়া আছে, চুক্তিপত্র আছে। প্রয়োজনে তাদের বিরুদ্ধে মামলা করে টাকা আদায় করা হবে।
বোয়ালমারীর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ঝোটন চন্দ গণমাধ্যমকে বলেন, বিষয়টি তিনি জেনেছেন এবং ঋণের টাকা আদায় করার জন্য লাল নোটিশ ইস্যু করেছেন। টাকা আদায় না হলে আইনি প্রক্রিয়ায় যাওয়া হবে।
সম্পাদক ও প্রকাশকঃ মোঃ মুরসিদ আহমেদ সিকদার, মোবাইল : 01728 311111
ঢাকা অফিসঃ হোল্ডিং-১৩, লাইন-৬, রোড- ১২, ব্লক-বি, মিরপুর-১১, ঢাকা-১২১৬
ফরিদপুর অফিসঃ মুজিব সড়ক, ফরিদপুর, ই-মেইলঃ [email protected]
Copyright © August, 2020-2025 @ Daily Somoyer Protyasha