রাজধানীর অধিকাংশ বাসা-বাড়ির পয়ঃবর্জ্য সুয়ারেজ লাইনের মাধ্যমে খাল, নদী, লেক বা ঝিলে গিয়ে পড়ত। পয়ঃবর্জ্য ব্যবস্থাপনার সক্ষমতা ছিল না ঢাকা ওয়াসার। এতে নগরজীবন ও খাল-নদীর পরিবেশ চরমভাবে দূষিত হতো। সেখান থেকে বেরিয়ে পয়ঃবর্জ্য ব্যবস্থাপনায় মাইলফলক অর্জন করতে যাচ্ছে ঢাকা ওয়াসা। পৃথক পাঁচটি পয়ঃশোধনাগার প্রকল্প বাস্তবায়নে কাজ করছে সংস্থাটি। এরই মধ্যে দাশেরকান্দির অত্যাধুনিক পরিবেশবান্ধব পয়ঃশোধনাগারের নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। ব্যয় হয়েছে ৩ হাজার ৪৮২ কোটি টাকা। আজ বৃহস্পতিবার এটি উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
রাজধানীর আফতাবনগরের দাশেরকান্দিতে ৬২ একর জমির ওপর নির্মিত হয়েছে এই পয়ঃশোধনাগার। এখানে দৈনিক ৫০ কোটি লিটার পয়ঃবর্জ্য পরিশোধন হচ্ছে। এছাড়া পরিশোধনের মাধ্যমে প্রতিদিন প্রায় ৪৫ টন ফ্লাই অ্যাশ (ছাঁই) পাওয়া যাবে। নর্দমা থেকে পরিশোধিত পরিষ্কার ও দুর্গন্ধমুক্ত পানি যাবে বালু নদীতে, যা নদীর পানির গুণগত মান বাড়ানোর পাশাপাশি তা সুপেয় করে তুলবে।
বর্তমানে রাজধানীতে ১৭৫ কোটি লিটার পয়ঃবর্জ্য তৈরি হয়। দাশেরকান্দি পয়ঃশোধনাগারে এর ২০-২৫ শতাংশ পরিশোধন করা হবে। বাকি ১৪০ কোটি লিটার পয়ঃবর্জ্য ঢাকা ও চারপাশের নদী, খাল এবং জলাশয়ে মিশছে। এর ফলে নগরীর পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। তবে সরকারের মাস্টার প্ল্যানে ঢাকা মহানগরীকে ৫টি (পাগলা, দাশেরকান্দি, উত্তরা, রায়েরবাজার ও মিরপুর) ক্যাচমেন্টে বিভক্ত করা হয়েছে। এই পাঁচটি প্ল্যান্ট বাস্তবায়ন হলে নগরবাসীর শতভাগ উন্নত ও টেকসই পয়ঃসেবা নিশ্চিত হবে বলে জানিয়েছেন ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খান।
দাশেরকান্দি পয়ঃশোধনাগার প্রকল্পের মাধ্যমে রাজধানীর রমনা থানার অন্তর্গত মগবাজার, ওয়ারলেস রোড, ইস্কাটন, নয়াটোলা, মৌচাক, আউটার সার্কুলার রোড, মহানগর হাউজিং এলাকা, কলাবাগান, ধানমন্ডি (পূর্বাংশ), তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল, তেজগাঁও এলাকা, নাখালপাড়া, গুলশান, বনানী, বাড্ডা, আফতাবনগর, নিকেতন, সাঁতারকুল ও হাতিরঝিল এলাকার পয়ঃবর্জ্য পরিশোধন করা হবে। এছাড়া সায়েদাবাদ পানি শোধনাগার ফেজ-১ ও ফেজ-২ এর ইনটেক পয়েন্ট শীতলক্ষ্যা নদীর দূষণ কমাবে। পাগলা পয়ঃশোধনাগারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের পর থেকেই পুরোদমে কাজ শুরু হবে। এর মাধ্যমে কলাবাগান, মগবাজার, শাহবাগ, ইস্কাটন, আরামবাগ, পল্টন, সায়েদাবাদ, মতিঝিল, রামপুরা, তালতলা, বাসাবো, গোলাপবাগ, আহমেদবাগ, শহীদবাগ, গোরান, বেগুনবাড়ি, খিলগাঁও, পশ্চিম নন্দীপাড়া এলাকার পয়ঃবর্জ্য পরিশোধন করা হবে।
গত মঙ্গলবার দাশেরকান্দি পয়ঃশোধনাগার পরিদর্শনে গিয়ে তাকসিম এ খান সাংবাদিকদের বলেন, দাশেরকান্দি পয়ঃশোধনাগার পাঁচটি মাস্টার প্ল্যানের একটি। চীন যে কয়টি সুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট করেছে তার মধ্যে এটি শ্রেষ্ঠ। এর কর্মকাণ্ড উচ্চমানের। রায়েরবাজার সুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টের কাজ অনেক দূর এগিয়েছে। এসব প্রকল্পের সবচেয়ে বড় কাজ হচ্ছে জমি অধিগ্রহণ করা। এই কাজটা আমাদের এগিয়েছে। উত্তরায় জমি অধিগ্রহণ প্রায় চূড়ান্ত। মিরপুর প্ল্যান্টের কাজ এগিয়ে চলছে। এর ডিজাইন ড্রয়িং হয়েছে, ফাইনাল হয়নি। তবে ওয়াসার পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০৩০ সালের মাধ্যে উত্তরা, রায়েরবাজার, মিরপুর, নারায়ণগঞ্জের পাগলায় পয়ঃশোধনাগার নির্মাণ করা হলে নদীদূষণের মাত্রা ৯০ শতাংশ কমে যাবে।
তিনি আরো জানান, দাশেরকান্দি প্ল্যান্টে দৈনিক ৫ মিলিয়ন মেট্রিক টন পয়ঃবর্জ্য পরিশোধনের ক্ষমতা আছে। তা রাজধানীর মোট পয়ঃশোধনের ২০ থেকে ২৫ শতাংশ। এ ধরনের একক পয়ঃশোধানাগার দক্ষিণ এশিয়ায় বৃহত্তম এবং এটিই সেরা। এটি পরিবেশবান্ধব, টেকসই ও জনবান্ধব। বাকি চারটি প্ল্যান্ট দিয়ে ২০৩০ সালের মধ্যে সারাদেশে উন্নত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিশ্চিতের মাধ্যমে এসডিজি লক্ষ্য-৬ বাস্তবায়নে সহায়ক হবে। বাংলাদেশকে ডিজিটাল করতে সরকারের উদ্যোগের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ঢাকা ওয়াসা তাদের কার্যক্রমের ৭০ শতাংশ ডিজিটালাইজড করেছে। পদ্মা ও সায়েদাবাদ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট সম্পূর্ণ অটোমেটেড। উন্নয়নের মহাসড়কে সরকারের যাত্রায় আমরা সঙ্গী।
ওয়াসা সূত্র জানায়, চীনের অর্থায়নে ৩ হাজার ৪৮২ কোটি ৪২ লাখ টাকা ব্যয়ে প্রায় ৬২ দশমিক ২ একর জমিতে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হয়। এই অর্থের ১ হাজার ১০৬ কোটি ৪২ কোটি টাকা জিওবি তহবিল থেকে এবং ১০ কোটি টাকা ওয়াসার তহবিল থেকে দেয়া হয়েছে। এছাড়া চীনের এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট ব্যাংক এই প্রকল্পে অর্থায়ন করেছে। প্রকল্পের বাকি ২ হাজার ৩৬৬ কোটি টাকা ব্যাংকটি থেকে সহায়তা হিসেবে দিয়েছে। এই প্রকল্পে প্রতিদিন প্রায় ৫৬০ টন প্রক্রিয়াকরণ ক্ষমতাসহ একটি স্লাজ ড্রাইং-বার্নিং সিস্টেম রয়েছে। এর নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০১৭ সালের ১ আগস্ট। পাওয়ার চায়নার অধীনে চেংডু ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশন দ্বারা ডিজাইন ও নির্মিত প্রকল্পটি এক বছরের অপারেশন ও রক্ষণাবেক্ষণের মাধ্যমে ওয়াসার কাছে হস্তান্তর করা হয়।
প্রকল্প সূত্র জানায়, প্রগতি সরণিতে রামপুরা সেতুর পশ্চিম পাশে একটি বর্জ্য উত্তোলন স্টেশন, রামপুরা থেকে আফতাবনগর পর্যন্ত পাঁচ কিলোমিটার ট্রাঙ্ক স্যুয়ার লাইন এবং দাশেরকান্দিতে মূল শোধনাগার নির্মাণ করা হয়েছে। এখন দাশেরকান্দি শোধানাগারে খিলগাঁও থানার অন্তর্গত আফতাবনগরসংলগ্ন এবং গুলশান (একাংশ), বনানী, তেজগাঁও, নিকেতন, মগবাজার, মালিবাগ, আফতাবনগর, বাড্ডা, কলাবাগান, পান্থপথ, ধানমন্ডি (একাংশ) ও হাতিরঝিলসহ রাজধানীর বেশ কয়েকটি এলাকার পয়ঃশোধনের ব্যবস্থা করবে। এর সুফল পাবে রাজধানীর ৫০ লাখ মানুষ।
দাশেরকান্দি পয়ঃশোধনাগার প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক মহসিন আলী জানান, এটি হাতিরঝিল সমন্বিত একটি প্রকল্পের অংশ। হাতিরঝিল করার সময় এই প্রকল্পে ডাইভারশন লাইন তৈরি করা হয়েছে। এর মধ্যে হাতিরঝিলের দক্ষিণ পাশে নির্মিত ছয়টি ও উত্তর পাশে নির্মিত ছয়টি স্পেশাল স্যুয়ারেজ ডাইভারশন স্ট্রাকচারে (এসএসডিএস) বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা পয়ঃবর্জ্য নতুন নির্মিত এই দাশেরকান্দি পয়ঃশোধানাগর আসছে। এসব এলাকা থেকে আসা প্রায় ৫০ কোটি লিটার পয়ঃবর্জ্য শোধন করে ফেলা হচ্ছে বালু নদীতে। এতে প্রায় ৫টি খালসহ বালু ও শীতলক্ষ্যা নদীর দূষণ কমছে।
তিনি বলেন, পয়ঃবর্জ্য থেকে উৎপাদন করা ফ্লাই অ্যাশ সিমেন্ট কারখানায় বিক্রি করা হবে। সিমেন্ট উৎপাদনের জন্য ফ্লাই অ্যাশের দরকার হয়। এরই মধ্যে তিনটি সিমেন্ট কারখানা তা সংগ্রহ করে নিয়ে যাচ্ছে। পরে তাদের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে। এর মাধ্যমে ওয়াসা কিছু রাজস্ব আয় করতে পারবে।
সম্পাদক ও প্রকাশকঃ মোঃ মুরসিদ আহমেদ সিকদার, মোবাইল : 01728 311111
ঢাকা অফিসঃ হোল্ডিং-১৩, লাইন-৬, রোড- ১২, ব্লক-বি, মিরপুর-১১, ঢাকা-১২১৬
ফরিদপুর অফিসঃ মুজিব সড়ক, ফরিদপুর, ই-মেইলঃ [email protected]
Copyright © August, 2020-2025 @ Daily Somoyer Protyasha