জাপানের নাগরিক কেনগো সিবাতা। আন্তর্জাতিক চোরাকারবারি। বাংলাদেশ ও ভারত তার গন্তব্যস্থল। ২০১৮ সালের ১২ জানুয়ারি বাংলাদেশে সোনা পাচার করতে এসে ধরা পড়েন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ১১ কেজি সোনা পাচারের চেষ্টা করেছিলেন সিবাতা। এই অভিযোগে তার বিরুদ্ধে বিমানবন্দর থানায় মামলা হয়। আদালত তাকে কারাগারে পাঠায়। কয়েক মাস জেল খেটে জামিন নিয়ে উধাও হয়ে যান তিনি। পুলিশ তাকে হন্যে হয়ে খুঁজছে।
নাইজেরিয়ার নাগরিক একিন উইসডোম ও চিগোজি। বছর দুয়েক আগে সোনা এবং জাল ডলারসহ গ্রেপ্তার হন তারা। মামলায় জামিন হওয়ার পর তাদেরও হদিস মিলছে না। তারা বাংলাদেশে আছেন নাকি নিজ দেশে পালিয়ে গেছেন, তাও কেউ বলতে পারছে না।
মোট ১৩৯ জন বিদেশি চোরাকারবারি জামিন নিয়ে গা-ঢাকা দিয়ে আছেন। তাদের বিষয়ে কোনো তথ্য নেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে। এসব চোরাকারবারির বেশিরভাগ সোনা পাচারকারী। তারা শাহজালাল, শাহ আমানত, ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও কয়েকটি সীমান্ত এলাকা দিয়ে সোনা, জাল ডলার ও অন্য চোরাই মাল পাচার করছিলেন।
তাদের সর্বশেষ অবস্থান জানতে পুলিশের সব কটি ইউনিটকে নির্দেশনা দিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর। বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশনে এবং দেশের সব কটি সীমান্ত এলাকায় বিশেষ বার্তা পাঠানো হয়েছে। শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর এবং কাস্টম হাউজও তাদের হদিস জানার চেষ্টা করছে। পুলিশ জেনেছে, তারা কারাগারে ছিলেন অনেক দিন। পরে জামিন নিয়ে বেরিয়ে গা-ঢাকা দিয়েছেন।
সংশ্লিষ্টরা জানান, গত পাঁচ বছরে অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি), পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) ও র্যাব বিভিন্ন অপরাধে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে সহস্রাধিক বিদেশিকে প্রেপ্তার করে। তাদের মধ্যে চোরাকারবারির সংখ্যাই বেশি। ফেসবুকে উপহারের নামে প্রতারণা, হেরোইন-কোকেনসহ মাদকের কারবার, ব্যাংকের এটিএম বুথে জালিয়াতি, বিভিন্ন দেশের জাল মুদ্রার কারবার, অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসা, সোনা চোরাচালান, অনলাইনে ক্যাসিনো ও মানব পাচারে জড়িত তারা। তাদের বেশির ভাগ সোনা পাচারে জড়িত বলে পুলিশ জেনেছে। তাদের অনেকে দেশের বিভিন্ন কারাগারে আটক আছেন।
এসব অপরাধীর মধ্যে ১৩৯ জন বিদেশি চোরাকারবারি জামিন নিয়ে লাপাত্তা বলে সম্প্রতি পুলিশের একটি ইউনিটের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। তাদের বেশির ভাগ সোনা পাচারকারী। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দীর্ঘদিন ধরে সোনা ও বৈদেশিক মুদ্রা পাচারের নিরাপদ রুট হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। আন্তর্জাতিক চোরাচালান চক্র, বিভিন্ন দেশের মাফিয়ারা এসব করছে। পাচার করার সময় সোনার বারসহ আটক হচ্ছেন তারা। থানায় মামলা হচ্ছে। কিন্তু কাউকেই আটকে রাখা যাচ্ছে না। আসামিরা জামিন নিয়ে লাপাত্তা হয়ে যাচ্ছেন। তাদের কেউ বাংলাদেশেই আত্মগোপন করে আছেন; কেউ বাংলাদেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। এ কারণে থমকে আছে সংশ্লিষ্ট অধিকাংশ মামলার তদন্তকাজ। উদ্ধার হওয়া সোনার বিষয়গুলোর সুরাহা হচ্ছে না। আর বিচারের দীর্ঘসূত্রতার কারণে সরকার বঞ্চিত হচ্ছে রাজস্ব থেকে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান গণমাধ্যমকে বলেন, ‘যেসব বিদেশির ভিসা নেই, কাজ করার পারমিট নেই, তাদের আইনের আওতায় আনতে কাজ করছে পুলিশ-র্যাবসহ সব কটি গোয়েন্দা সংস্থা। যেসব বিদেশি জামিন নিয়ে কারাগার থেকে বের হয়েছে, তাদের বিষয়েও আমরা কাজ করছি। চোরাকারবারি ও অন্য বিদেশি অপরাধীদের আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। পুলিশকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।’
পুলিশের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৯ সালের ৭ আগস্ট ৬ কোটি টাকা মূল্যের ১২ কেজি সোনাসহ ধরা পড়েন জাপানি নাগরিক তাকিও মিমুরা। ৭ জুলাই দেড় কোটি টাকা মূল্যের ৪ কেজি সোনাসহ গ্রেপ্তার হন চীনা নাগরিক জু জিয়াং। বিপুল পরিমাণ সোনাসহ ধরা পড়েন কলকাতার আমির খান। বিভিন্ন সময়ে ভারতের ঈশ্বর দাস, সৌরভ ম-ল, রমেশ কুমার ভার্মা, সালেকিন শেখ, সৌমিক দত্ত, কুলদীপ সিং, ওয়াসিম, গুজরাট সিং, প্রকাশ, রেখা, উর্মিলা কুমার, অনিক কুমার, বিনোদ কুমার, গুরজন্ত সিং, বিজয় কুমার ও দিনেশ; পাকিস্তানের আরশাদ আয়াজ আহমেদ, রাশেদ মো. খালেদ; চীনের চেন সিম ফাত, চেন জিলা, দিং শোশেং, জু ইয়ংগাং ও লুতেংচেং; জাপানের শুইচি সাতো; মালয়েশিয়ার চ্যান গি কিউনগ, রাজা বসলিনা বিনতি; ক্যামেরুনের নোগোমবি বাছি, নাইজেরিয়ার নন্দিকা ক্লিনেন্ট, ক্লেটাস আছুনা, ওইউকুলভ টিমটি, একিন উইসডোম, দক্ষিণ আফ্রিকার চিগোজি, ইভুন্ডে গ্যাব্রিল ওবিনা, স্যালেস্টাইন প্যাট্রিক, মর্দি নামদি, ওরদু চুকওরদু সাম্মি, ডুবুওকন সোমায়ইনা, জেয়েরেম প্রেসিয়াস একমি এবং ওক উইসডম; দুবাইয়ের রমজান আলীসহ অনেক বিদেশির হদিস মিলছে না।
হদিস না পাওয়ার বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের অতিরিক্ত আইজিপি পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা বলেন, ‘বিদেশিদের মধ্যে অন্তত ১৩৯ জন জামিন নিয়ে উধাও হয়ে গেছে। পুলিশের একটি ইউনিট এবং শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর বিষয়টি আমাদের জানিয়েছে। পলাতকদের অবস্থান জানতে পুলিশের সব কটি ইউনিটকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশনে ও সীমান্ত এলাকায় বিশেষ বার্তা পাঠানো হয়েছে। বিদেশিদের কেউ দেশের বাইরে পালিয়ে গেছে কি না, তা খুঁজে বের করতে বলা হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘বিদেশিরা প্রতারণা, মাদক ও জাল টাকার কারবারসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকা- চালাচ্ছে। তাদের বিষয়ে সতর্ক থাকতে জেলা পুলিশ সুপারদেরও দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘বিদেশি অপরাধীরা ভিসার মেয়াদ শেষ হলে পাসপোর্ট ছিঁড়ে ফেলছে। তখন জানা সম্ভব হয় না, তারা কোন দেশের নাগরিক। কিছুদিন আগে আইনশৃঙ্খলা-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভার বৈঠকে জামিনে বের হওয়া বিদেশি চোরাকারবারিদের বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।’
শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে বলেন, ‘বিদেশি নাগরিকদের কাছ থেকে সোনা, বিদেশি মুদ্রা ও মাদকদ্রব্য আটকের ঘটনায় ফৌজদারি মামলার বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অবহিত করা হয়েছে। বিদেশি চোরাকারবারিদের অনেকেই আন্তর্জাতিক মাপের অপরাধী। তারা বাংলাদেশে দেদার সোনা পাচার করে। জাল ডলারের কারবারও করে। তাদের আইনের আওতায় আনতে সব কটি বিমানবন্দরে নজরদারি কয়েক ধাপ বাড়ানো হয়েছে।’
সম্পাদক ও প্রকাশকঃ এ. এস.এম মুরসিদ, মোবাইল : 01728 311111
ঢাকা অফিসঃ হোল্ডিং-১৩, লাইন-৬, রোড- ১২, ব্লক-বি, মিরপুর-১১, ঢাকা-১২১৬
ফরিদপুর অফিসঃ মুজিব সড়ক, ফরিদপুর, ই-মেইলঃ [email protected]
Copyright © August, 2020-2025 @ Daily Somoyer Protyasha