ঈদের ছুটিতে গ্রামে ফেরা মানেই রাজধানীর বাহিরমুখে দুর্বিসহ যানজট আর পথে পথে ভোগান্তি। ঈদুল ফিরতে ঘরমুখো মানুষের যাতায়াত নির্বিঘœ করতে বিআরটির একাংশ খুলে দেয়া হয়েছে। এবারও উত্তরাঞ্চল, টাঙ্গাইল আর ময়মনসিংহ বিভাগের বিভিন্ন জেলাগামী যাত্রীদের দুর্ভোগ দূর করতে ঈদের আগেই বিআরটি’র আরেকটি অংশ খুলে দেয়া হচ্ছে। বিমানবন্দর থেকে গাজীপুর বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) লাইনের নির্মাণকাজ শেষ পর্যায়ে। এরইমধ্যে উত্তরার হাউজ বিল্ডিং থেকে টঙ্গী স্টেশন পর্যন্ত প্রকল্পের ফ্লাইওভারের একাংশের উদ্বোধন করা হয়েছে। ঈদের আগেই বিমানবন্দর সড়কের উভয়পাশ ও জসিমউদদীন সড়ক-সংলগ্ন রুটও যানবাহন চলাচল করবে। এতে দীর্ঘদিনের ভোগান্তির অবসান হবে, যাতায়াতে ফিরবে স্বস্তি। ঈদের ঘরমুখো লাখো মানুষ ভোগান্তির হাত থেকে রক্ষা পাবেন।
বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পের আওতায় উত্তরা থেকে টঙ্গী কলেজ গেট পর্যন্ত ফ্লাইওভার গতকাল শনিবার জনসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে। টঙ্গীতে এক অনুষ্ঠানে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের প্রকল্পের ৪ দশমিক ৫ কিলোমিটার অংশ উদ্বোধন করেন। ফ্লাইওভার পরিদর্শন শেষে সেতুমন্ত্রী বলেন, পুরো বিআরটি প্রকল্পের প্রায় ৯১ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে এবং হাউস বিল্ডিং থেকে চেরাগ আলী কলেজ গেট পর্যন্ত এলিভেটেড অংশের ৯৫ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর বা অক্টোবরের মধ্যে পুরো প্রকল্পের কাজ শেষ হবে বলেও জানান তিনি। ওবায়দুল কাদের আরও বলেন, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর বা অক্টোবরে ঢাকার আগারগাঁও থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেল সার্ভিস চালু হবে।
সেতুমন্ত্রী বলেন, প্রকল্পটি নিয়ে অনেক ভোগান্তি হয়েছে, আশা করি ভোগান্তি আর থাকবে না। এখন বর্ষার মৌসুম, তাছাড়া কোরবানির পশুর গাড়ি ও যানবাহনের ধীরগতিতে চলাচলে কিছুটা ভোগান্তি হতে পারে। ভোগান্তি কমাতে একটি পরিকল্পনা করা হয়েছে। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে বিআরটি প্রকল্পের কাজ শেষ হচ্ছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হবে কি, হবে না, সেই দ্বন্দ্বের মধ্যে ছিল। তারপরও প্রকল্পটির মেয়াদ বাড়ানো হয়। আমাদের সবচেয়ে বেশি দরকার সড়কে শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা। এটি একটি চ্যালেঞ্জ। তিনি আরো বলেন, আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে আমরা তেজগাঁও পর্যন্ত এলিভেটেডের অংশ ও মেট্রোরেলের কাজ মতিঝিল এলাকা পর্যন্ত শেষ করতে পারব। ঈদুল আজহার আগে সড়কে যানজট কমাতে পোশাক কারখানার মালিকদের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। এছাড়া রাজধানীর জসিমউদ্দিন থেকে বিমানবন্দর এলাকায় অংশের কাজ শেষে ঈদের আগেই খুলে দেওয়া হবে।
জানা গেছে, ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগ সহজ করতে গাজীপুর থেকে বিমানবন্দর ও উত্তরার হাউজ বিল্ডিং থেকে টঙ্গীর চেরাগআলী মার্কেট পর্যন্ত এ সড়ক নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে আর্টিকুলেটেড বাসের মাধ্যমে প্রতি ঘণ্টায় ২৫ হাজার মানুষ যাতায়াত করতে পারবে। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কেও যানজট অনেক কমে যাবে। যাতায়াতে সময় কম লাগবে। আগের চেয়ে বেশিবার আপ-ডাউন করতে পারায় যানবাহনের মালিকরাও লাভবান হবেন। অন্যদিকে যাত্রীরা দ্রুত কর্মস্থলে পৌঁছাতে পারবে। ফলে কর্মদক্ষতা বাড়বে, যা অর্থনীতিতে ব্যাপক গতি আনবে। যাত্রীরা অর্থনৈতিকভাবে উপকৃতও হবেন। তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত হবে। ১০০টি আর্টিকুলেটেড বাসের টিকিট বিক্রির মাধ্যমে অর্জিত টাকা সরকারের রাজস্ব খাতকে শক্তিশালী করবে।
বিআরটি প্রকল্পের কাজের জন্য দীর্ঘদিন থেকে প্রতিদিন এই গুরুত্বপূর্ণ ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে ভোগান্তিতে পড়ছে লাখো মানুষ। ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে আটকে থাকছে যানবাহন। এই প্রকল্পের নির্মাণকাজ নিয়ে সমালোচনার শেষ ছিল না। যাত্রীদের দুর্ভোগ ছিল অন্তহীন। অনেক যাত্রী বিমানের ফ্লাইটও মিস করেছেন। বিআরটি প্রকল্পের গার্ডারের নিচে চাপা পড়ে প্রাইভেটকারে পাঁচ জন নিহত ঘটনায় প্রকল্পের কর্তৃপক্ষের গাফিলতির কারণেই হয়েছে বলে বলছেন যোগাযোগ সংশ্লিটরা।
আরামদায়ক, ব্যয়সাশ্রয়ী, পরিবেশবান্ধব, আধুনিক, টেকসই ও নিরাপদ নগর পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে গাজীপুর-টঙ্গী-উত্তরা-বিমানবন্দর করিডোরে বিআরটি লাইন নির্মাণ করা হচ্ছে। হাউজ বিল্ডিং থেকে চেরাগআলী পর্যন্ত সাড়ে চার কিলোমিটার এলিভেটেড ফ্লাইওভার ও সেতু। এর মধ্যে সাড়ে তিন কিলোমিটার ছয় লেনের সড়ক। এক কিলোমিটার দুই লেনের সড়ক। ছয়টি এলিভেটেড স্টেশন ও একটি ১০ লেনের টঙ্গী সেতু নির্মাণ করা হচ্ছে। এ রুটে চলাচলের জন্য আন্তর্জাতিক টেন্ডারের মাধ্যমে কেনা হবে আর্টিকুলেটেড বাস। এ র্যাপিড ট্রানজিট লাইন চালু হলে দুর্ভোগের ঢাকা-গাজীপুর সড়ক মাত্র ৪০ মিনিটেই পাড়ি দেওয়া যাবে। এ রুটে বাস মিলবে দেড় থেকে তিন মিনিট পরপর।
জানা গেছে, এ প্রকল্পের কাজ ২০২২ সালের জুনে শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু এখনো প্রকল্পের কাজ শেষ হয়নি। এ রুটে চলাচলকারী মানুষের দুর্ভোগের সীমা নেই। ঈদে এ রুটে যানজট কয়েকগুণ বেড়ে যায়। ফলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ২০ কিলোমিটার সড়কে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। তবে ঈদের আগে এ সড়কে স্বস্তি মিলবে বলে জানিয়েছে সওজ। চার হাজার ২৬৮ কোটি ৩২ লাখ ৪৩ হাজার টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি যৌথভাবে বাস্তবায়ন করছে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর (এলজিইডি) ও বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ (বিবিএ)। বাংলাদেশ সরকারের পাশাপাশি প্রকল্পে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), ফরাসি উন্নয়ন সংস্থা (এএফডি) ও গ্লোবাল এনভায়রনমেন্ট ফ্যাসিলিটি (জিইএফ) অর্থায়ন করছে।
সম্পূর্ণ প্রকল্পের মাধ্যমে ২০ দশমিক ৫ কিলোমিটার সড়ক উন্নয়নে সওজের কাজ ১৬ কিলোমিটার, যার মধ্যে সাতটি ফ্লাইওভার রয়েছে। এর মধ্যে একটি চুক্তির মাধ্যমে বাস্তবায়িত হচ্ছে। পাকেজের একটি ভ্যারিয়েশন প্রক্রিয়াধীন। সেই ভ্যারিয়েশন অনুযায়ী-প্যাকেজের ভৌত অগ্রগতি ৯০ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ এবং আর্থিক অগ্রগতি ৭৩ শতাংশ। বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের আওতায় ৪ দশমিক ৫ কিলোমিটার ফ্লাইওভার নির্মাণের অগ্রগতি ৮৫ শতাংশ। অন্যদিকে এলজিইডির আওতাধীন দুটি প্যাকেজের অগ্রগতি শতভাগ। প্রকল্পের সার্বিক ভৌত অগ্রগতি ৮৮ দশমিক ৩ শতাংশ এবং আর্থিক অগ্রগতি ৮০ শতাংশ। চলতি অর্থবছর বরাদ্দ ৩০২ কোটি টাকা, যার মধ্যে ২৬৬ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। অবশিষ্ট ৩৬ কোটি টাকা এ অর্থবছর খরচ করা সম্ভব। তবে ঠিকাদারের কাজের অগ্রগতি আশানুরূপ নয়। বিমানবন্দর ফ্লাইওভারের কাজ এ অর্থবছরে শেষ করার চেষ্টা চলছে। একদিকে এরইমধ্যে যান চলাচল শুরু হয়েছে। অপর অংশে যান চলাচল জুলাইয়ে শুরু করা সম্ভব হবে।
১০ লেনের টঙ্গী সেতু নির্মাণ করবে সড়ক ও জনপথ বিভাগ। এছাড়া তারা ১৬ কিলোমিটার সড়ক উন্নয়ন ও প্রশস্তকরণ, বিআরটি লেন, সাতটি ফ্লাইওভার, ১৯টি বিআরটি স্টেশন, ২০ কিলোমিটার চেইন এবং দুটি টার্মিনাল নির্মাণ করবে। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সংলগ্ন আন্ডারগ্রাউন্ড পথচারী টানেলও নির্মাণ করা হবে এ বিভাগের আওতায়। অন্যদিকে সৌর বিদ্যুৎচালিত সড়ক বাতি স্থাপন করবে সওজ।
সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের প্রধান প্রকৌশলী মো. ইসহাক বলেন, আশা করছি, দ্রুত উত্তরার জসিমউদদীন সড়কের অংশ ও বিমানবন্দর সড়কের উভয়পাশ খুলে দেওয়া সম্ভব হবে। ঈদের আগে এ সড়কে চলাচলে কষ্ট থাকবে না। বিমানবন্দর থেকে টঙ্গী সহজেই যাতায়াত করা যাবে। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রীর নির্দেশনা রয়েছে যাতে ঈদের আগেই বিআরটি লেনের কিছু অংশ খুলে দেওয়া হয়। নির্দেশনার আলোকে প্রকল্প-সংশ্লিষ্টরা রাত-দিন নিরলস পরিশ্রম করছেন।
তিনি বলেন, ভোগরা পর্যন্ত সব স্টেশনের কাজ ঈদের আগে শেষ করা সম্ভব। জয়দেবপুর ফ্লাইওভারের ৫৪টি পিসি গার্ডারের মধ্যে ৪৭টির স্থাপনের কাজ শেষ হয়েছে। বাকি মাত্র সাতটি। চৌরাস্তা ফ্লাইওভারের গার্ডারের বিষয়ে সওজের প্রধান প্রকৌশলীর পর্যালোচনা অনুযায়ী- বুয়েটের সঙ্গে আলাপ করে এবং পরিদর্শন শেষে ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলা হয়েছে। এ বিষয়ে বুয়েট বরাবর চিঠি দেওয়া হয়েছে।
জানতে চাইলে বিআরটি প্রকল্পের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সফিকুল ইসলাম ইনকিলাবকে বলেন, যানজট নিরসন ও সড়ক ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা আনতে পুরোদমে কাজ চলছে বিআরটি প্রকল্পের। প্রকল্পের বিমানবন্দর সড়কের উভয়পাশ ও জসিমউদদীন সড়ক-সংলগ্ন রুট ঈদুল আজহার আগে খুলে দেওয়া হবে। তবে ঈদের আগে এই অংশটুকু খুলে দেয়া হবে এটা ঠিক। এতে দীর্ঘদিনের ভোগান্তির অবসান হবে, যাতায়াতে ফিরবে স্বস্তি।
সম্পাদক ও প্রকাশকঃ মোঃ মুরসিদ আহমেদ সিকদার, মোবাইল : 01728 311111
ঢাকা অফিসঃ হোল্ডিং-১৩, লাইন-৬, রোড- ১২, ব্লক-বি, মিরপুর-১১, ঢাকা-১২১৬
ফরিদপুর অফিসঃ মুজিব সড়ক, ফরিদপুর, ই-মেইলঃ [email protected]
Copyright © August, 2020-2025 @ Daily Somoyer Protyasha