প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জাপান, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য সফরের আগে ইন্দো-প্যাসিফিক রূপরেখা (আউটলুক) ঘোষণাকে সরকারের বুদ্ধিদীপ্ত ও সময়োপযোগী কূটনীতি হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের অভিমত, প্রধানমন্ত্রীর তিন গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন সহযোগী দেশ সফরের আগ মুহূর্তে ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের অধিবাসী হিসেবে বাংলাদেশ নিজস্ব অবস্থান, ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব ও লক্ষ্য তুলে ধরেছে। আর ভূ-রাজনীতি ও কৌশলগত এই স্পষ্ট বার্তা নিয়েই সফরে গেছেন সরকারপ্রধান।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ক্রমবর্ধমান বিশ্বরাজনীতির মেরূকরণ-প্রক্রিয়ায় সব উদ্যোগ ও পদক্ষেপ মার্কিন-চীন প্রতিদ্বন্দ্বিতার লেন্সে দেখা হয়। বাংলাদেশের ইন্দো-প্যাসিফিক রূপরেখাও এর ব্যতিক্রম নয়। বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক ও ভূকৌশলগত অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ নিজেদের স্পষ্ট অবস্থান দৃঢ়তার সঙ্গেই জানাতে পেরেছে। ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সীমান্ত থাকায় দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে যোগাযোগ স্থাপনে বাংলাদেশের গুরুত্ব অপরিসীম। সার্ক, আসিয়ান, বিমসটেকসহ যে কোনো আঞ্চলিক ফোরামে সমন্বয়েও বাংলাদেশ অতুলনীয়। স্থিতিশীলতা, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে ঐতিহাসিক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের গুরুত্ব বাড়িয়েছে। এদিকে, বঙ্গোপসাগরের ১২টি সমুদ্রবন্দরের তিনটিই (চট্টগ্রাম, মোংলা ও পায়রা) বাংলাদেশে অবস্থিত। এ ছাড়া বাংলাদেশের গভীর সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশের আগ্রহও জ্বালানি খাতের জন্য বেশ সম্ভাবনাময়। এসব কারণে টানাপোড়েন সত্ত্বেও বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ককে গুরুত্ব দিয়ে এগিয়ে নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ইন্দো-প্যাসিফিক রূপরেখা ঘোষণার পর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতি বাইডেন প্রশাসনের মনোযোগ আরও বাড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
জাপানের উদ্যোগে ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল (আইপিএস) আলোচনায় এলেও এর প্রধান উদ্যোক্তা যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্র ও জাপান ছাড়াও কানাডা, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্সসহ বিভিন্ন দেশ তাদের আইপিএস ঘোষণা করেছে। তাদের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র সবচেয়ে সক্রিয়। আইপিএসকে কেন্দ্র করে এরই মধ্যে মার্কিন নেতৃত্বে ভারত, অস্ট্রেলিয়া ও জাপানকে নিয়ে নিরাপত্তাবিষয়ক চার দেশীয় কোয়াডও গঠিত হয়েছে। ভূ-রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও কৌশলগত কারণে শুরু থেকেই যুক্তরাষ্ট্র আইপিএসে বাংলাদেশকে সঙ্গে রাখতে দেনদরবার করছিল। বাংলাদেশ বরাবরই নিরাপত্তার চেয়ে অর্থনৈতিক সহযোগিতার পাশাপাশি উন্মুক্ত, নিরাপদ এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক ইন্দো-প্যাসিফিকের ওপর জোর দিয়েছে। এদিকে পশ্চিমাদের আইপিএসের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য চীনের প্রভাব কমানো। চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ও বিনিয়োগের সম্পর্ক রয়েছে এবং দেশটির বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভেও (বিআরআই) বাংলাদেশ যুক্ত রয়েছে। ফলে চ্যালেঞ্জ নিয়েই চির প্রতিদ্বন্দ্বী মার্কিন-চীনের সঙ্গে ভারসাম্যের সম্পর্ক রক্ষা করে চলেছে শেখ হাসিনার সরকার।
চলতি বছরে দুই প্রভাবশালী দেশের গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তাদের কাছাকাছি সময়ে বাংলাদেশ সফরেও দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্র আইপিএসে বাংলাদেশকে রাখতে মরিয়া হয়ে ওঠে, আর চীন তা ঠেকাতে চেষ্টা করে। অন্যদিকে র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা, অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও নির্বাচন নিয়ে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের নানা বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের টানাপোড়েন বেড়েই চলছিল। মার্কিন সহকারী মন্ত্রী ডোনাল্ড লুর সফরের পর সম্পর্কের পালে কিছুটা হাওয়া লাগলেও যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য এবং ফেসবুক পোস্টে প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও প্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের সাম্প্রতিক পোস্ট সম্পর্কে অস্বস্তি বাড়িয়েছে। কূটনৈতিক সূত্র বলছে, দেশের মানুষকে আশ্বস্ত করার জন্যই সংসদে প্রধানমন্ত্রীর এ ধরনের বক্তব্য। এমন বাস্তবতায় ওয়াশিংটনে যাওয়ার আগে বাংলাদেশের ইন্দো-প্যাসিফিক রূপরেখা ঘোষণাকে সম্পর্কে গতি আনার প্রচেষ্টা হিসেবেও দেখছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা মনে করেন, আইপিএস নিয়ে বাংলাদেশের ভাবনা জানতে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাবিশ্ব। প্রধানমন্ত্রীর তিন দেশ সফরের সময়েও এ নিয়ে আলোচনা হবে। তার আগেই বাংলাদেশের রূপরেখা ঘোষণার ফলে বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্ট দেশগুলো বিচার বিশ্লেষণ করার সুযোগ পেয়েছে।
এ প্রসঙ্গে সাবেক রাষ্ট্রদূত ও আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক হুমায়ুন কবীর বলেন, ইন্দো-প্যাসিফিক নিয়ে বাংলাদেশের প্রত্যাশা ও অবস্থান কী হবে—এটা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে আলোচনা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর সফরের আগে সরকার রূপরেখা ঘোষণা করায় সফরের সময়ে টকিং পয়েন্ট হিসেবে আইপিএস থাকবে বলে ধারণা করছি। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার বলে দিয়েছে। এখন বিভিন্ন দেশ বাংলাদেশের রূপরেখা নিয়ে আলোচনা ও বিচার বিশ্লেষণ করবে।
চীনের সঙ্গে সব দেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক থাকলেও কারও আইপিএসে নেই চীন। বরং ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে চীনের প্রভাব ঠেকাতেই একজোট হয়েছে পশ্চিমারা। যুক্তরাষ্ট্র যখন আইপিএস নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে দেনদরবার করছিল, তখন চীন নানাভাবে সরকারকে বিরত রাখার প্রচেষ্টা চালিয়েছে। ঢাকায় নিযুক্ত সাবেক চীনা রাষ্ট্রদূত সম্পর্কের অবনতি হবে বলেও হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন। সরকার ঘোষিত এ রূপরেখার কারণে চীনের অসন্তুষ্ট হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ প্রসঙ্গে হুমায়ুন কবীর বলেন, আজকের বিশ্বে চীনের সঙ্গে ভারত, জাপান ও আসিয়ান দেশসহ সব দেশেরই অর্থনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে। অস্বীকার করার উপায় নেই, বর্তমান বিশ্বের অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে চীনের গুরুত্ব অনেক। এটা যুক্তরাষ্ট্রও জানে। আর চীনও বুঝে, বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক এগিয়ে নিতে হবে। তবে সরকারকে কূটনৈতিক প্রজ্ঞা ও দক্ষতার সঙ্গে বিষয়গুলো সঠিকভাবে উপস্থাপন ও ম্যানেজ করতে হবে।
নির্বাচনী বছরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকারের মূল ফোকাস অর্থনৈতিক উন্নয়ন অব্যাহত রাখা। এ উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন বিদেশি বিনিয়োগ ও বাণিজ্যের সম্প্রসারণ। এ কারণে ভারত, চীন, যুক্তরাষ্ট্র, জাপানসহ প্রভাবশালী দেশগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্ক অব্যাহত রেখে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাড়াতে জোর তৎপরতা চালাচ্ছে বাংলাদেশ। বিশেষ করে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের কৌশলের সঙ্গে ভেবেচিন্তে ভারসাম্য বজায় রেখে একের পর এক কূটনৈতিক দক্ষতা দেখিয়ে চলেছে শেখ হাসিনার সরকার। ইন্দো-প্যাসিফিক রূপরেখা ঘোষণার পর প্রশ্ন উঠেছে, বাংলাদেশ কি ‘পশ্চিমের দিকে ঝুঁকে গেল?
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের চেয়ারপারসন প্রফেসর ড. লাইলুফার ইয়াসমিন বলেন, কূটনীতিতে সময়জ্ঞান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রধানমন্ত্রী তিন দেশ সফরের প্রথমেই জাপান যাচ্ছেন। অনেকে মনে করেন, ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল (আইপিএস) যুক্তরাষ্ট্রের ধারণা। আইপিএস আসলে ইন্ট্রোডিউস করেছে জাপান। আর স্বভাবতই বাংলাদেশ যখন আইপিএস নিয়ে চিন্তা করবে, অবশ্যই পররাষ্ট্রনীতির লক্ষ্য মাথায় রেখেই করবে। ইন্দো-প্যাসিফিক নিয়ে বাংলাদেশের রূপরেখার চার মৌলিক নীতির প্রথমেই রয়েছে সরকারের পররাষ্ট্রনীতির মূল কথা। সেখানে স্পষ্টই পুনর্ব্যক্ত করা হয়েছে, বাংলাদেশ কোনো ব্লকে যুক্ত হওয়ার পক্ষে নয়। বরং ইন্দো-প্যাসিফিকের অধিবাসী হিসেবে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরেছে। যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, জাপানসহ বিভিন্ন দেশের কৌশলপত্রে অঞ্চল সংজ্ঞায়িত করার ক্ষেত্রে বোঝাপড়ার ভিন্নতা রয়েছে। ওভারল্যাপিং এ ভৌগোলিক সীমানা ও ইন্দো-প্যাসিফিক বাসিন্দা চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের রূপরেখায় বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে অঞ্চল শব্দটি পরিহার করা হয়েছে। বরং রূপরেখায় সরকার বাংলাদেশের নিজস্ব অবস্থান, ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব ও লক্ষ্য তুলে ধরেছে।
লাইলুফার আরও বলেন, ইন্দো-প্যাসিফিক রূপরেখা বাংলাদেশের স্বতন্ত্র অবস্থান। চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) ভিন্ন ধরনের অর্থনৈতিক উদ্যোগ, যা পুরো বিশ্বে বিস্তৃত। অন্যদিকে, আইপিএস একটা কৌশল, যা ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে সীমাবদ্ধ। তাই এ দুটোকে প্যারালাল হিসেবে দাঁড় করিয়ে তুলনা হতে পারে না। আর মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশ কিন্তু আইপিএস সমর্থন বা অনুমোদন দেয়নি, ইন্দো-প্যাসিফিক নিয়ে নিজেদের প্রত্যাশা ও অবস্থান রূপরেখায় তুলে ধরেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের রূপরেখা ঘোষণায় ঢাকা-ওয়াশিংটন সম্পর্ক চাঙ্গা হবে। এরই মধ্যে শীর্ষস্থানীয় মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানি এক্সন মবিল গভীর সমুদ্রের ১৫টি ব্লকে অনুসন্ধান চালানোর জন্য সরকারের কাছে লিখিত প্রস্তাব দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী এ প্রস্তাবে নীতিগত সম্মতি দেওয়ার পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারকদের মার্কিন কোম্পানিটির সঙ্গে চুক্তি চূড়ান্ত করার আগে দেশের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে খতিয়ে দেখার নির্দেশ দিয়েছেন। অন্যদিকে, স্বভাবতই এ রূপরেখায় অসন্তুষ্ট হবে চীন। তাই আগামী দিনে দুই পরাশক্তির সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষায় কূটনৈতিক দক্ষতার প্রতি মনোযোগী হতে সরকারকে পরামর্শ দিয়েছেন বিশ্লেষকরা।
সম্পাদক ও প্রকাশকঃ মোঃ মুরসিদ আহমেদ সিকদার, মোবাইল : 01728 311111
ঢাকা অফিসঃ হোল্ডিং-১৩, লাইন-৬, রোড- ১২, ব্লক-বি, মিরপুর-১১, ঢাকা-১২১৬
ফরিদপুর অফিসঃ মুজিব সড়ক, ফরিদপুর, ই-মেইলঃ [email protected]
Copyright © August, 2020-2025 @ Daily Somoyer Protyasha