আগম ও নির্গম। নবনির্বাচিত রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন শপথ নিলেন গতকাল সোমবার বঙ্গভবনের দরবার হলে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিপুল সংখ্যক গণ্যমান্য অতিথির উপস্থিতিতে শপথ পড়ান জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। দেশের ইতিহাসে ২১তম ও বিদায়ী রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ২২তম রাষ্ট্রপতিকে মঞ্চে ফুল দিয়ে অভিনন্দন জানান এবং দায়িত্ব হস্তান্তরের অংশ হিসেবে নিজ নিজ আসন বদল করেন। তখন হাজারের বেশি অতিথির মুহুর্মুহু করতালিতে মুখরিত হয় ভাবগম্ভীর মিলনায়তন।
যে দেশে অর্ধশতাব্দীতে একাধিক রাষ্ট্রপতি নিহত হয়েছেন; মেয়াদ পূর্ণ করার নজির কম, সেখানে মো. আবদুল হামিদের শান্তিপূর্ণভাবে দুই মেয়াদ পূর্ণ করে বঙ্গভবন থেকে আনুষ্ঠানিক রাজসিক বিদায় নেওয়ার ঘটনা দেশে স্থিতিশীল ও সাংবিধানিক ধারাবাহিকতাকে তুলে ধরে। রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন সংবিধানের রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধানের শপথ উচ্চারণ করেন। তিনি ও স্পিকার শপথ নথিতে স্বাক্ষর করেন।
বেলা ১১টায় শপথ অনুষ্ঠান হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী, বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ কন্যা শেখ রেহানা, মন্ত্রিসভার সদস্য, সংসদ সদস্যসহ শতাধিক বিশিষ্ট অতিথি উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেন। অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ, তিন বাহিনীর প্রধান, কূটনীতিক, সম্পাদকসহ সিনিয়র সাংবাদিক এবং পদস্থ বেসামরিক ও সামরিক কর্মকর্তারা। রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ নতুন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও স্পিকারকে সঙ্গে নিয়ে বেলা ১০টা ৫৫ মিনিটে বঙ্গভবনের দরবার হলে প্রবেশ করেন। এ সময় নতুন রাষ্ট্রপতি কালো মুজিবকোট ও সাদা পাঞ্জাবি পরা ছিলেন। একটি সামরিক ব্যান্ড আনুষ্ঠানিক সংগীত পরিবেশন করে তাদের স্বাগত জানায়।
আনুষ্ঠানিকতা শেষ হওয়ার পর নতুন রাষ্ট্রপতিকে অভিনন্দন জানান প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিপরিষদ সদস্যসহ অন্যরা। এ সময় নতুন রাষ্ট্রপতির স্ত্রী ড. রেবেকা সুলতানা, ছেলে আরশাদ আদনান রনিসহ পরিবারের সদস্যরাও উপস্থিত ছিলেন।
ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী হিসেবে গত ১৩ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রপতি পদে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন মো. সাহাবুদ্দিন। তাঁর রয়েছে আইন পেশা, বিচারালয় ও দুদকে দায়িত্ব পালনের বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ার।
দরবার হলে এই শপথ অনুষ্ঠান শুরু হয় কোরআন তেলাওয়াতের মধ্য দিয়ে। অনুষ্ঠানের মঞ্চে ছিল তিনটি চেয়ার। মাঝের চেয়ারে বসেন মো. আবদুল হামিদ; তাঁর ডান পাশে মো. সাহাবুদ্দিন আর বাঁ পাশে স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী। শপথ অনুষ্ঠান শেষ হয় জাতীয় সংগীত দিয়ে। শপথ অনুষ্ঠানের পর রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন বঙ্গভবন থেকে গুলশানের বাসায় যান। সন্ধ্যার পর তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে বঙ্গভবনে ওঠেন।
বিদায়ী রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ শপথ অনুষ্ঠানের পর ঢাকার নিকুঞ্জ আবাসিক এলাকায় তাঁর নিজের বাড়িতে ওঠেন।
শপথ অনুষ্ঠানের পরপরই হয় মো. আবদুল হামিদের বিদায় অনুষ্ঠান। সর্বোচ্চ সম্মান দিয়ে রাজসিক কায়দায় তাঁকে বিদায় জানায় বঙ্গভবন, যা দেশে আর কোনো রাষ্ট্রপতির ক্ষেত্রে ঘটেনি।
ছাত্র রাজনীতি থেকে বঙ্গভবনে
ছয় দফা আন্দোলনের সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে রাজপথে নেমেছিলেন মো. সাহাবুদ্দিন। তাঁর জন্ম ১৯৪৯ সালে পাবনা শহরের জুবিলি ট্যাঙ্কপাড়ায় (শিবরামপুর)। শৈশব কেটেছে ওই শহরেই। সনদপত্রে নাম মো. সাহাবুদ্দিন হলেও ডাকনাম চুপ্পু হিসেবে তিনি বেশি পরিচিত।
রাধানগর মজুমদার অ্যাকাডেমি থেকে ১৯৬৬ সালে এসএসসি পাসের পর পাবনার এডওয়ার্ড কলেজে ভর্তি হয়ে জড়িয়ে পড়েন ছাত্র রাজনীতিতে। এডওয়ার্ড কলেজ থেকে ১৯৬৮ সালে এইচএসসি ও ১৯৭১ সালে (অনুষ্ঠিত ১৯৭২) বিএসসি পাস করেন করেন মো. সাহাবুদ্দিন। পরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৭৪ সালে মনোবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ও পাবনা শহীদ অ্যাডভোকেট আমিনুদ্দিন আইন কলেজ থেকে ১৯৭৫ সালে এলএলবি ডিগ্রি পান। ছাত্রলীগে যুক্ত হওয়ার পর এডওয়ার্ড কলেজ শাখার সাধারণ সম্পাদক, অবিভক্ত পাবনা জেলা ছাত্রলীগের সহসভাপতি থেকে ছয় বছর জেলা ছাত্রলীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন মো. সাহাবুদ্দিন।
১৯৭১ সালে পাবনা জেলার স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়কের পদে থাকা সাহাবুদ্দিন মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। ছাত্রলীগের সক্রিয় কাজের ধারাবাহিকতায় ১৯৭৪ সালে পাবনা জেলা যুবলীগের সভাপতির দায়িত্বে আসেন। ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) গঠিত হলে তিনি পাবনা জেলা কমিটির যুগ্ম মহাসচিব মনোনীত হন।
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর তাঁর দল আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকে গ্রেপ্তার করে সে সময় ক্ষমতা দখলকারীরা। মো. সাহাবুদ্দিনকেও তখন কারাবরণ করতে হয়। কারামুক্তির পর পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদকের দায়িত্ব পান তিনি।
পেশাজীবনের শুরুতে পাবনা জেলা আইনজীবী সমিতির সদস্য ছিলেন সাহাবুদ্দিন। ১৯৮২ সালে বিসিএস (বিচার) পরীক্ষা দিয়ে তিনি বিচারক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৯৫ ও ’৯৬ সালে পরপর দুইবার বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব নির্বাচিত হন তিনি।
বিচারালয়ে বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন শেষে জেলা ও দায়রা জজ হিসেবে ২০০৬ সালে অবসরে যান মো. সাহাবুদ্দিন। এর মধ্যে শ্রম আদালতের চেয়ারম্যান পদেও তিনি ছিলেন। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় আইন মন্ত্রণালয় নিযুক্ত সমন্বয়কারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন তখনকার বিচারক মো. সাহাবুদ্দিন। বিচারক জীবনের ইতি টানার পর আবারও তিনি আইন পেশায় ফেরেন। ২০০৮ থেকে ’১১ সাল পর্যন্ত সুপ্রিম কোটের্র আইনজীবী থাকার মধ্যে সরকার তাঁকে দুর্নীতি দমন কমিশনের কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব দেয়। ২০১৬ সাল পর্যন্ত তিনি সেই দায়িত্ব পালন করেন।
২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় আসার পরপরই আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জনগোষ্ঠীর ওপর হামলার ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিশনের প্রধান ছিলেন মো. সাহাবুদ্দিন। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে তিনি আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। এর পর দলের সর্বশেষ জাতীয় কাউন্সিলে নির্বাচন কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
বর্ণাঢ্য কর্মজীবনে সাংবাদিকতা পেশাতেও যুক্ত ছিলেন মো. সাহাবুদ্দিন। বিচার বিভাগে যোগ দেওয়ার আগে ১৯৮০ থেকে দুই বছর দৈনিক বাংলার বাণীতে সাংবাদিকতা করেন তিনি। পাবনা প্রেস ক্লাব ও অন্নদা গোবিন্দ পাবলিক লাইব্রেরিতেও তিনি সদস্য ছিলেন।
মো. সাহাবুদ্দিন জেএমসি বিল্ডার্স লিমিটেডের প্রতিনিধি হিসেবে ২০১৭ সালে ইসলামী ব্যাংকের ভাইস চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেন। এ ব্যাংকের অডিট কমিটিরও সদস্য ছিলেন তিনি। রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার পর নিয়ম অনুযায়ী তিনি সেই পদ ছেড়ে দেন।
ব্যক্তিগত জীবনে মো. সাহাবুদ্দিন এক ছেলের বাবা। তাঁর স্ত্রী ড. রেবেকা সুলতানা যুগ্ম সচিব ছিলেন। তিনি বর্তমানে প্রাইম এশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক অ্যাডভাইজারের পাশাপাশি ফ্রেন্ডস ফর চিলড্রেন অর্গানাইজেশনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন।
সম্পাদক ও প্রকাশকঃ মোঃ মুরসিদ আহমেদ (লিটু সিকদার), মোবাইল : 01728 311111
ঢাকা অফিসঃ হোল্ডিং-১৩, লাইন-৬, রোড- ১২, ব্লক-বি, মিরপুর-১১, ঢাকা-১২১৬
ফরিদপুর অফিসঃ মুজিব সড়ক, ফরিদপুর, ই-মেইলঃ [email protected]
Copyright © August, 2020-2025 @ Daily Somoyer Protyasha