পবিত্র রমজান মাস সামনে রেখে গত জানুয়ারি মাসে সাত পণ্যের সাড়ে ১২ লাখ টন আমদানির জন্য ঋণপত্র খোলা হয়। ছোলা, মসুর ডাল, সয়াবিন তেল ও পাম তেলের পর্যাপ্ত মজুদ আছে। পেঁয়াজের আমদানি ভালো থাকায় দামে অস্থিরতা নেই। ঠিকঠাকমতো আমদানি হলে চিনি ও খেজুরের সংকট হবে না। ডলারসংকটের কারণে চিনির দাম কমার সম্ভাবনা তেমন নেই। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর বলছে, বাজার তদারকি নিশ্চিত করলে নতুন করে এসব পণ্যের দাম বাড়বে না।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম শফিকুজ্জামান গণমাধ্যমকে বলেন, ‘জানুয়ারি পর্যন্ত যে তথ্য আছে তাতে আমদানির কোনো সংকট নেই। বিভিন্ন সরকারি উদ্যোগের পর ঋণপত্র খোলায়ও গতি এসেছে। ফলে আমদানি ঋণপত্র নিয়ে চিন্তা নেই। চিন্তাটা হচ্ছে বাজারে রমজানের পণ্য সরবরাহ সঠিক সময়ে পৌঁছানো। আমরা সেই লক্ষ্যে কাজ করছি।’ তিনি আরো বলেন, ‘আমদানি থেকে বিক্রি পর্যন্ত যত পর্যায়ে এসব পণ্য হাতবদল হয় তার কোনো পর্যায়েই যাতে সেগুলো মজুদ না হয় তা গোয়েন্দা সংস্থার কাছ থেকে তথ্য নিয়ে নজরদারি করা হচ্ছে। ব্যবসায়ীদের মিটিংয়েও সার্বিক চিত্র তুলে ধরা হবে। বাজার তদারকিতে এবার সর্বোচ্চ নজর দেব। বাজার কমিটিকেও সম্পৃক্ত করব। কোনো গাফিলতি থাকলে তাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলাও করব।’
শঙ্কা কাটছে চিনিতে : ঋণপত্র খুলতে না পারা এবং আমদানির পর ডলারে মূল্য পরিশোধ করতে না পারায় চিনি আমদানি নিয়ে এত দিন শঙ্কা ছিল। চাহিদার বিপরীতে ডিসেম্বর পর্যন্ত চিনি আমদানি ২২ শতাংশ কম হয়েছিল। জানুয়ারিতে এসে সেই শঙ্কা কেটেছে।
কাস্টমসের হিসাবে, ২০২১ সালের জুলাই থেকে ডিসেম্বর এই ছয় মাসে অপরিশোধিত চিনি আমদানির পরিমাণ ছিল ৯ লাখ ৪১ হাজার টন। ২০২২ সালের জুলাই থেকে ডিসেম্বর এই ছয় মাসে দেশে মোট সাত লাখ ৩৩ হাজার টন অপরিশোধিত চিনি আমদানি করা হয়েছে। আর শুধু জানুয়ারিতে আমদানি করা হয়েছে এক লাখ ৭৮ হাজার টন। সে হিসাবে জুলাই থেকে জানুয়ারি এই সাত মাসে চিনি এসেছে ৯ লাখ ২১ হাজার টন। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে জানুয়ারিতে চিনি আমদানির ঋণপত্র খোলা হয়েছে পাঁচ লাখ ৬৫ হাজার টন। সেই হিসাবে ১৪ লাখ ৮৬ হাজার টন চিনি ফেব্রুয়ারির মধ্যেই পৌঁছার কথা।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, দেশে চিনির মোট চাহিদা থাকে প্রায় ২০ লাখ টন। আখ থেকে চিনির উৎপাদন ৩০ হাজার টন। বাকি চাহিদা আমদানি করে মেটানো হয়। সারা বছর প্রতি মাসে গড়ে চিনির চাহিদা দেড় লাখ টনের মতো। রমজানে চিনির চাহিদা বেড়ে দ্বিগুণ হয় অর্থাৎ তিন লাখ টনে উন্নীত হয়। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, রোজা শুরুর আগেই প্রায় ১৫ লাখ টন চিনি পৌঁছে যাবে গুদামে। পর্যায়ক্রমে আরো চিনি আসবে।
চট্টগ্রাম বন্দরের হিসাবে, শুধু ফেব্রুয়ারি মাসেই চিনিবাহী জাহাজ এসেছে পাঁচটি, যেখানে পরিশোধিত ও অপরিশোধিত চিনিই আছে দুই লাখ ৪১ হাজার টন। সব বড় শিল্প গ্রুপ এই চিনি আমদানি করেছে। গেল ডিসেম্বর ও জানুয়ারির কিছু চিনির যে ঋণপত্র খোলা হয়েছে, সেই চিনি এখন দেশে পৌঁছেছে। কিন্তু জানুয়ারিতেই চিনি আমদানির ঋণপত্র খোলা হয়েছে পাঁচ লাখ ৬৫ হাজার টনের। এর মধ্যে সর্বোচ্চ এক লাখ টন চিনি দেশে পৌঁছেছে। বাকি চিনি পৌঁছবে মার্চের মধ্যে।
খাতুনগঞ্জের এক আড়তদার গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আগে যে চিনি এসেছে সেগুলো পরিশোধন করে কারখানা থেকে বাজারে সরবরাহ হবে। এতে সংকট দূরে থাক, বাজারে দাম পড়ে যাবে। সরকার অন্তত এই তদারকিটা নিশ্চিত করুক। তখন দেখবেন বাজার কোথায় নামে!’
এস আলম গ্রুপের শীর্ষ এক কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য রমজান পর্যন্ত প্রতি মাসে এক লাখ টন চিনি দেশে পৌঁছানো। আর পরবর্তী মাসগুলোতেও সেটি অব্যাহত থাকবে। কিন্তু ডলার সংকটের কারণে দাম বাড়তি থাকবে। তবে সেটা আহামরি বেশি হবে না।’
কমেছে ছোলার দাম : রোজার সাত পণ্যের মধ্যে চিনি, খেজুর ও ছোলা নিয়ে শঙ্কা ছিল বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের। কারণ আমদানি তুলনামূলক কম থাকায় ডিসেম্বর পর্যন্তও সেই শঙ্কা ছিল। কিন্তু ফেব্রুয়ারি মাসে এসে সেই শঙ্কা কেটেছে। এক সপ্তাহ ধরে চট্টগ্রামের পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জে ছোলার বাজারে বেচাকেনা একেবারেই কমে গেছে। দামও আগের মতোই আছে।
জানতে চাইলে খাতুনগঞ্জের আড়তদার তৈয়্যবিয়া ট্রেডার্সের কর্ণধার সোলায়মান বাদশা বলেন, ‘বড় শিল্প গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়ায় রমজানের ভোগ্য পণ্যের বাজার নিয়ে অস্থিরতা ছিল। কেমন দাম হবে, সেটিও আঁচ করা যাচ্ছিল না। এখন ভারত থেকে ছোট ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা ছোলা আনছেন স্থলবন্দর দিয়ে। সেই ছোলা চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে ঢুকেছে প্রতিদিন ২০ ট্রাক পর্যন্ত। এখন ভারতের ছোলা বাজারের সব দোকানে বিক্রি করা হচ্ছে। নতুন করে দাম বাড়েনি রমজানে চাহিদার শীর্ষে থাকা এই পণ্যের।
খাতুনগঞ্জের আরেক ব্যবসায়ী আরিফ মো. ফোরকান বলেন, ভারতের ছোলা ঢুকছে গত সপ্তাহ থেকেই। ফলে বাজারে দাম বাড়ার প্রবণতা কমেছে। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ‘ভারত থেকে আসা ছোলা এখন বিক্রি করছি প্রায় ৮২ টাকায়। গত সপ্তাহে সেটি বিক্রি করেছি ৮৪-৮৫ টাকায়। ফলে কেজিতে দাম দু-তিন টাকা কমেছে।’
হিলি স্থলবন্দর দিয়ে বিপুল পরিমাণ ছোলা ঢোকার কথা জানান আমদানিকারক শহীদুল ইসলাম। তিনি বলেন, ভারত থেকে ১০ দিন ধরে আসছে ছোলা। ট্রেডিং করেন এমন ছোট-মাঝারি ব্যবসায়ীরাই ছোট আকারে ছোলা আনছেন। প্রতিদিন শুধু এই বন্দর দিয়েই ২০ ট্রাক ছোলা ঢুকছে। ছোলা বিক্রি হচ্ছে ৭৮-৭৯ টাকা কেজি দরে।
সংকট হবে না খেজুরের : পুরো বছর যেখানে খেজুরের চাহিদা এক লাখ টন; শুধু রমজানে সেই চাহিদা থাকে ৫০ হাজার টন। ২০২২ সালের জুলাই-ডিসেম্বরে খেজুর আমদানি করা হয় ১১ হাজার ৭৭৩ টন। ২০২১ সালে আমদানি করা হয়েছিল ১২ হাজার ১৫৩ টন। অর্থাৎ আমদানি কমেছে ৩ শতাংশ। আর শুধু জানুয়ারিতে আমদানি করা হয়েছে সাত হাজার ৭৭০ টন। ফলে শেষ সাত মাসে আমদানি হয়েছে সাড়ে ১৯ হাজার টন। এ ছাড়া গত অক্টোবরে চার হাজার ৮০০ টন, নভেম্বরে সাড়ে চার হাজার টন এবং ডিসেম্বরে পৌনে ১৩ হাজার টন খেজুর আমদানির ঋণপত্র খোলা হয়েছে। আর জানুয়ারিতে ঋণপত্র খোলা হয়েছে প্রায় সাড়ে ২৯ হাজার টন। ফলে সব খেজুর ঠিকঠাকমতো এলে উদ্বৃত্ত থাকবে।
সয়াবিন তেল আমদানিও ভালো : বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, ২০২১ সালের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে অপরিশোধিত সয়াবিন তেল এসেছে দুই লাখ ৯৭ হাজার টন। আর ২০২২ সালের একই সময়ে এসেছে তিন লাখ ২১ হাজার টন। ফলে আমদানি বেড়েছে ৮ শতাংশ। শুধু গত জানুয়ারিতে এসেছে ৩৭ হাজার ৬৫৫ টন। সে হিসাবে জুলাই থেকে জানুয়ারি এই সাত মাসে আমদানি করা হয়েছে প্রায় তিন লাখ ৫৯ হাজার টন।
আর বীজ আকারে সয়াবিন ২০২২ সালে এসেছে সাত লাখ ১৪ হাজার টন। ২০২১ সালের একই সময়ে এসেছিল পাঁচ লাখ ৭৯ হাজার টন। ফলে সেখানেও আমদানি বেড়েছে ২৩ শতাংশ।
গত নভেম্বর-ডিসেম্বরে সয়াবিন আমদানিতে ঋণপত্র খোলা কমলেও জানুয়ারিতে ঋণপত্র খোলা হয়েছে তিন লাখ ৯০ হাজার টন। সেই তেল বাজারে পৌঁছলেই চাহিদা মিটিয়ে উদ্বৃত্ত থাকবে। খাতুনগঞ্জের এক ভোজ্য তেল ব্যবসায়ী কালের কণ্ঠকে বলেন, তেল ঠিকঠাকমতো বাজারে এলেই দাম ধরে রাখার সুযোগ থাকবে না। বাজার ঠিক থাকবে।
পাম তেলের পর্যাপ্ত মজুদ : বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, দেশে ভোজ্য তেলের চাহিদা ২০ লাখ টন। গত জুলাই-ডিসেম্বর পর্যন্ত ছয় মাসে অপরিশোধিত পাম তেল আমদানি হয়েছে মাত্র ১২ হাজার টন। অথচ ২০২১ সালের একই সময়ে আমদানি করা হয়েছিল প্রায় এক লাখ ৪৫ হাজার টন। আর গত জুলাই-ডিসেম্বর ছয় মাসে পরিশোধিত পাম তেল আমদানি করা হয়েছে ৯ লাখ ৫২ হাজার টন। ২০২১ সালের একই সময়ে আমদানি করা হয়েছিল তিন লাখ ৯২ হাজার টন। আমদানি বেড়েছে রেকর্ড পরিমাণ, ১৪৩ শতাংশ।
আর গত অক্টোবরে এক লাখ ২২ হাজার টন, নভেম্বরে ৮২ হাজার টন, ডিসেম্বরে সাড়ে ৫৪ হাজার টন এবং জানুয়ারিতে তিন লাখ ৯০ হাজার টনের ঋণপত্র খোলা হয়েছে।
রেকর্ড আমদানিতেও বাড়তি মসুর ডালের দাম : গত ছয় মাসে প্রায় দুই লাখ টন মসুর ডাল আমদানি করেছেন ব্যবসায়ীরা। আগের ছয় মাসের তুলনায় এটা দ্বিগুণ। কনজিউমারস অ্যাসোসিয়েশন চট্টগ্রামের প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন বলেন, বাজার তদারকি না থাকলে যে পণ্যের দাম ইচ্ছামতো বাড়ান ব্যবসায়ীরা, মসুর ডাল তার ভালো উদাহরণ। ব্যবসায়ীদের দরকার একটি অজুহাত। আগে দাম বাড়িয়ে বিক্রি করেন, পরে যেনতেনভাবে একটি যুক্তি উপস্থাপন করেন। এখন তদারকি সংস্থার উচিত সেই ব্যবসায়ীরা যাতে অনৈতিক সুযোগ নিতে না পারেন, তার ব্যবস্থা নেওয়া।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, সারা দেশে মসুর ডালের চাহিদা বছরে ছয় লাখ টন। রমজান মাসে চাহিদা এক লাখ টন। কাস্টমস ও বন্দরের আমদানির তথ্য বলছে, ২০২২ সালের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে মসুর ডাল আমদানি হয়েছে এক লাখ ৯৯ হাজার টন। আর ২০২১ সালের একই সময়ে আমদানি করা হয়েছিল এক লাখ ৯ হাজার টন। আমদানি বেড়েছে ৮২ শতাংশ। আর শুধু জানুয়ারিতেই এসেছে ৩৯ হাজার ৬০০ টন মসুর ডাল। সে হিসাবে সাত মাসে মসুর ডাল আমদানি হয়েছে দুই লাখ ৩৯ হাজার টন।
গত অক্টোবর-ডিসেম্বর তিন মাসেই ঋণপত্র খোলা হয়েছে প্রায় ৩৭ হাজার টনের। কিন্তু বাজার তদারকি না থাকায় মসুর ডালের দাম বাড়ছে।
চিন্তা নেই পেঁয়াজ নিয়ে : বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, দেশে পেঁয়াজের বার্ষিক চাহিদা ২৫ লাখ টন। দেশে উৎপন্ন হয় ১৭ লাখ টন। আমদানি করা হয় সাত লাখ টন। আর শুধু রমজানেই প্রয়োজন হয় চার লাখ টন পেঁয়াজ। সেই পেঁয়াজ আমদানি করা হয়েছে।
২০২১ সালের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে পেঁয়াজ আমদানি করা হয়েছিল তিন লাখ ৪০ হাজার টন। আর ২০২২ সালের একই সময়ে আমদানি করা হয়েছে তিন লাখ ৮৬ হাজার টন। ফলে আমদানি বেড়েছে ১১ শতাংশ। শুধু ডিসেম্বরেই ৪৮ হাজার টন এবং জানুয়ারিতে সাড়ে ৪২ হাজার টন পেঁয়াজ আমদানির ঋণপত্র খোলা হয়েছে। ফলে বাজারে পেঁয়াজ নিয়ে শঙ্কা নেই। দামেও অস্থিরতা নেই।