আজকের তারিখ : নভেম্বর ২২, ২০২৪, ১১:৫১ পি.এম || প্রকাশকাল : জানুয়ারী ২১, ২০২৩, ১:১৩ পি.এম
কুষ্টিয়ার খোকসায় আজ শনিবার মধ্যরাতে মহিষ ও পাঠা বলির মধ্য দিয়ে শুরু হচ্ছে ৬শ বছরের ঐতিহ্যবাহী কালী পূজার মেলা। মাঘের শিশির ভেজা কনকনে শীতের সাথে সাথে খোকসায় শুরু হচ্ছে ঐতিহ্যবাহী কালী পূজার মেলা। কালীবাড়ীর বার্ষিক পূজা উপলক্ষে শনিবার দিবাগত গভীর রাতে মহিষ ও পাঁঠা বলির মধ্য দিয়ে শুরু হচ্ছে ১৫দিন ব্যাপী ঐতিহ্যবাহী কালিপুজা মেলা।
উপজেলা সদর দিয়ে প্রবাহিত গড়াই নদীর পূর্ব তীর ঘেঁষে সনাতনী ভক্তদের ধর্মীয় পর্যটন কেন্দ্র খোকসার বার্ষিক কালি পূজা ও ঐতিহ্যবাহী গ্রামীণ মেলাকে সামনে রেখে উৎসব মুখর পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। মাঘের আমাবষ্যা তিথি থেকে প্রতীমা তৈরীর কাজ শুরু করা হয়। ইতিমধ্যেই সাড়ে ১২ হাত লম্বা বিশাল দেহের কালী প্রতীমা তৈরীর কাজ শেষ করেছেন স্থানীয় প্রতীমা শিল্পীরা। এখন শুধু আনুষ্ঠানিকতা।
রাজা জমিদারী আমলের আদলে শনিবার গভীর রাতে প্রথাগত জীব বলির মধ্য দিয়ে বার্ষিক উৎসবের মূল পূজা শুরু হবে চলবে রবিবার বিকালে প্রতিমা বিসর্জন পর্যন্ত। দ্বিতীয় পর্বের পূজা হবে সপ্তমী তিথিতে। করোনার কারেণে বিগত ২ বছর তেমন গ্রামীণ মেলা না হলেও এ বছর কালীবাড়ির বিশাল মাঠ জুড়ে গ্রামীণ পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেছে প্রায় ৫ শতাধিক ব্যবসায়ীরা । গ্রামীণ মেলাকে ঘিরে ধর্ম ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে উৎসবমুখর পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে কালী পূজার মেলা প্রাঙ্গণ।
পুজা অনুষ্ঠানে আইন শৃংখলা রক্ষায় সবরকম ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন খোকসা থানা অফিসার ইনচার্জ সৈয়দ আশিকুর রহমান ও পুলিশ কর্মকর্তারা।খোকসায় কালিপুজায় ইতোমধ্যেই দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ও পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত থেকে হাজার হাজার ভক্ত দর্শনার্থী এসেছে। কুষ্টিয়া জেলার একটি ছোট উপজেলা খোকসা। পূর্বদিকে-রাজবাড়ী, উত্তরে-পাবনা, দক্ষিনে- ঝিনাইদহ, পশ্চিমে- কুমারখালি ও কুষ্টিয়া সদর। খোকসা থানার ২শ গজ পশ্চিমে বয়ে যাওয়া গড়াই নদীর তীরে এলাকার সনাতনী ভক্তদের ও ধর্মীয় পর্য়টন কেন্দ্র খোকসা কালীবাড়ী।
কালী পূজার ইতিহাসঃ খোকসার ঐতিহ্যবাহী কালীপূজা কোন সুদুর অতীতে শুরু হয়েছে তার সঠিক ইতিহাস নেই। তবে বর্তমানে পূজারী শ্রী প্রবোধ কুমার ভট্রাচার্যের সপ্তদশ ঊর্ধ্বতন পুরুষ রামাদেব তর্কলংকার এ পূজার প্রথম পূজারী ছিলেন। আর এ থেকে অনুমান করা হয় খোকসার কালীপূজার বয়স প্রায় ৬’শ বছর। আত্মপ্রচার বিমূখ তান্ত্রিক সাধু গড়াই নদীর তীরে খোকসা নামক এক জাতীয় গাছে বেষ্টিত জন মনুষ্যহীন জঙ্গালাকীন স্থানে এ কালীপূজা আরম্ভ করেন বলে লোক মুখে শোনা যায়।
জনৈক জমিদার পুত্রকে সর্প দংশন করলে চিকিৎসার জন্য এই সাধকের কাছে নেওয়া হয়। রোগীকে কালীর পদতলে শুইয়ে দিয়ে সাধনার মাধ্যমে জমিদার জুবাকে সুস্থ্য করে তোলেন সাধু। খবর পেয়ে জমিদার কালীর প্রতি ভক্তি আল্পুত করে ও তান্ত্রিক সাধুর নির্দেশে সাড়ে সাত হাত দীর্ঘ কালী মূর্তি নির্মাণ করে মাঘি আমাবশ্যার তিথিতে এখানে প্রথম কালীপূজা আরম্ভ করেন। আর সেই থেকে খোকসার কালীপূজার সূত্রপাত। মহিষ বলির শেষে পাংশার জমিদার ভৈয়বনাথ ও শিলাইদহের জমিদার ঠাকুরের সম্মানে জোড়ো পাঠা বলি দেওয়া হতো। সেই স্রোতধারায় এখনও দেশ-বিদেশ থেকে আগত ভক্তদের মানসার পাঠা বলি দেওয়া হয়।
কালের স্বাক্ষী খোকসার কালীবাড়ীঃ
বিশাল এক জোড়া বট ও পাকুর গাছ বেষ্টিত প্রাত্যাহিক পূজা মন্দির। পুজা মন্দিরে ডুকতেই বিলা গেট নির্মানকরা হয়েছে যা শোভা বর্ধন পাচ্ছে। এই সুবিশাল গেটটি পুজা মন্দিরের শ্রী বৃদ্ভিসহ আগত দর্শনাথীদেও মুগ্ধ করবে। এখানে রাখা আছে নলডাঙ্গার রাজা ইন্দু ভুষণ দেব রায় কর্তৃক গড়াই নদী থেকে প্রাপ্ত কৃষ্ণবর্ণের প্রস্তর খন্ড। এটি বৌদ্ধ আমলের নিদর্শন। এ প্রস্তর খন্ডের গঠন অনেকটা চৌকির মতো। কৃষ্ণবর্ণের প্রস্তর খন্ডটিকে সারা বছরই পূজা করা হয়। ২৭ ইঞ্চি লম্বা, ৪ ফুট চওড়া পিতলের পাত দিয়ে তৈরী শিব ঠাকুর পূজার পাট আসন উল্লেখযোগ্য। আগের পূজা মন্দিরটি প্রমত্তা গড়াই নদীতে বিলীন হয়ে যাওয়ায় ১৩৪১ বাংলা সালে পূজা মন্দিরটি বর্তমান স্থানে সরিয়ে আনা হয়।
বার্ষিক পূজা মন্দিরে প্রতি বছর মাঘি আমাবশ্যার তিথিতে সাড়ে সাত হাত লম্বা কালী মূর্তিসহ সাড়ে বার হাত দীর্ঘ মাটি ও খড় দিয়ে তৈরী কালীমূর্তি পূজান্তে বিসর্জন দেয়া হয়। এখানে নির্মান করা হয়েছে নাট মন্দির। বার্ষিক পূজা ও মেলায় আগত পূজার্থী এবং দর্শনার্থীদের সাময়িক বিশ্রামাগার ও পূজা কমিটির কার্যালয়। মন্দিরের সম্মুখে ভাগে রাস্তা এবং পশ্চিমে গড়াই নদী পর্যন্ত বিস্তৃত মাঠ এটাই মেলাঙ্গন। প্রতি বছর একই তিথিতে প্রচলিত নিয়মে এ পূজা হয়ে আসছে। মাঘি আমাবশ্যার এক মাস আগে কদম কাঠের কাঠমো তৈরী করা হয়। এ কাঠামেই খড় ও মাটি দিয়ে তৈরী মূর্তিতে বার্ষিক পূজা হয়ে থাকে। জমিদার আমলে এখানে এক মাসেরও অধিক সময় মেলা চলতো।
মহিষ ও পাঠা বলির সূচনাঃ
কালীপূজা শুরুতেই ক্রোধের প্রতীক মহিষ ও পাঠা বলির প্রথা চালু হয়। প্রথম দিকে পাঠা বলির সংখ্যা ছিল অনির্ধারিত। বার্ষিক পূজার দিনে প্রথম প্রহরে চন্ডি পাঠান্তে একটি পাঠা বলি দেয়া হতো। দিনের শেষ প্রহরে দেবিকে আসনে তোলার পর নড়াইলের জমিদার রতন বাবুদের পাঁচ শরিকের জন্য পাঁচটা পাঠা বলি; অতঃপর নলডাঙ্গার রাজা প্রেরিত মহিষ বলি হত। এরপর শিলাইদহের জমিদারী ষ্ট্রেট এর সন্মানে জোড়া পাঠা বলি হত। মাঘি সপ্তমীর পূজা ও মেলা পর্যন্ত চলতো ভক্তদের মানসার জন্য আনা পাঠা বলি। ক্রোধের পথিক মহিষ ও পাঠা বলীর এ প্রথা সেই রাজা জমিদারী আমলের আদলেই আজও প্রচলিত রয়েছে।
যুগ উপযোগী পরিকল্পনাঃ
রাজা-জমিদার প্রথা বিলুপ্তির পর খোকসা কালীপূজা ও গ্রামীণ মেলার প্রসার বহুলাংশে হ্রাস পেয়েছে। প্রমত্তা গড়াই নদীর অব্যাহত ভাঙনে নবাবী আমলে স্থাপত্য মন্দিরটি ১৩৪০ বাংলা সালে নদীগর্ভে বিলীন হওয়ার পরের বছর ১৩৪১ বঙ্গাব্দে স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায় প্রচেষ্টায় কালী মন্দিরটি নতুন করে তৈরী করা হয়। ইতোমধ্যে কালীবাড়িকে ঘিড়ে নেওয়া হয়েছে বেশ কিছু উদ্যোগ। গড়াই নদী পাড়ের নিত্য পূজার টিনের চার চালা ঘরটি গড়াই নদী গর্ভে বিলীন হওয়ার পর নতুন বিশাল মন্দির আজ শোভা বর্ধন করছে নবনির্মিত আধুনিক পূজা মন্দির ও পরিচালনা পরিষদের প্রশাসনিক কার্যালয়, নির্মিত হয়েছে সুবিশাল শ্মশান।
কালীপূজা ও মেলার সাড়ম্বর বৃদ্ধিঃ
বর্তমান পূজারীর পূর্বপুরুষ জনৈক পন্ডিতকে একদিন বিশালাকৃতির একটি মহিষ আক্রমন করলে উক্ত পন্ডিত হাতে থাকা চন্ডিগ্রস্থ ছুরে মেরে মহিষটি বধ করেন। এ ঘটনা নলডাঙ্গার রাজার কর্নগোচর হওয়ার পর আলৌকিক ক্ষমতা সম্পন্ন এ ব্রাহ্মন পরিবারের চার শরিকের জন্য ১৪শ বিঘা এবং কালীপূজার সঙ্গে সম্পৃক্ত কাঠামো তৈরীর মিস্ত্রি, ধোপা, নাপিত, মালাকার, ভুঁইমালী, ঢাকী ও পরিস্কার- পরিচ্ছন্নকারীকে চাকরানা হিসেবে ১২ বিঘা করে জমি নিস্কর ভোগের সুযোগসহ বার্ষিক পূজার সাত দিন দপাম্বিতা খরচ নির্বাহের জন্য ১৬ বিঘা জমি দান করেন। কালীপূজা মেলা স্থানান্তর করে ব্যাপক সংস্কার কর্মসূচী গৃহীত হয়।
বর্তমান পূজা কমিটিসহ এলাকার সুধি জনেরা দায়িত্ব গ্রহণের পর ২৮ অগ্রাহায়ন ১৩৮৯ বঙ্গাব্দের আমাবশ্যার তিথিতে বার্ষিক পূজা মন্দিরটি পাকাকরণসহ সংস্কৃতি চতুম্পট ভবন নির্মানের মাধ্যমে কাব্য, ব্যাকারণ, ন্যায় ও স্মৃতি বিষয়ে শীক্ষাদান ধর্মীয় পাঠাগার, প্রাত্যহিক ও বার্ষিক পূজার সময়ে আগত ভক্তদের জন্য সেবায়েত ভবন ও কালীবাড়ীর সীমানা প্রাচীর নির্মানের ব্যাপক কর্মসূচী গৃহীত হলেও নানাবিধ সমস্যা বিদ্যামান থাকায় শুধুমাত্র বার্ষিক পূজা মন্দির, সংস্কৃতি চতুষ্পাট ভবন ও দর্শনার্থীদের বিশ্রামগার এবং সীমানা প্রাচীর নির্মান কাজ সম্পন্ন হয়েছে।
এ ব্যাপাবে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও উপজেলা চেয়ারম্যান বাবুল আখতার বলেন খোকসার কালীপূজার মন্দিরটি ঐতিহ্যবাহী মন্দির, ঐতিহ্যমন্ডিত মন্দিরটিতে প্রায় ৬শ বছর ধরে কালিপুজা ও মেলা হয়ে আসছে। সুষ্ট ও সুন্দর পুজা অনুষ্ঠান করতে সরকার ও আমার দল বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে।
উপজেলা নির্বাহী আফিসার রিপন বিশ্বাস বলেন ইতিমধ্যে কালিপূজার সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে,প্রশাসনের পক্ষ থেকে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে, তিনি কালিপুজা উৎসবকে সার্থক ও সুন্দর করতে সকলের আন্তরিক সহযোগিতা কামনা করেন। কালী পূজা মন্দিরের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক দুলাল চন্দ্র বিশ্বাস বলেন আমি আশা করি প্রতিবারের মত এবার আপামর জনসাধারণ ধর্মবর্ণ সকল দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে কালী পূজার মেলায় সবান্ধবে উপস্থিত হয়ে মেলাকে আরোও প্রানোবন্ধ করবে। তিনি মেলা উৎসবকে সার্থক ও সুন্দর করতে সকলের সার্বিক সহযোগিতা কামনা করেন।
শেষ কথাঃ
খোকসার কালীপূজার মন্দিরটি ঐতিহ্যবাহী মন্দির, ঐতিহ্যমন্ডিত কালীপূজা মন্দির ও ধর্মীয় পর্যটন কেন্দ্রটি সম্পর্কে আজও কোন ইতিহাস রচনা করা হয়নি। তবে খোকসার কালী পূজা মন্দির ও ধর্মীয় পর্যটন কেন্দ্রটি সুষ্ঠু সংরক্ষণ ও প্রসার বৃদ্ধি সময়ের দাবীতে পরিণত হয়েছে।