আবহমান বাংলার এক আনন্দঘন উৎসবের ঋতু হেমন্ত।শরৎরাণীর বিদায় বার্তা ঘোষিত হতেই কুয়াশার চাদরে ঘোমটা দিয়ে,হেমন্ত আসে চুপিসারে।খেতে খামারে রাশি রাশি ভারা ভারা সোনার ধানের উপর শিশির বিন্দু, সকালের নবীন সুর্যের সোনালী আলোক রশ্মি মুক্তা দানার মতো চিকচিক করে, কৃষাণ-কৃষাণীর মনে জাগায় আনন্দের হিল্লোল। চলে নতুন অতিথিকে ঘরে তোলার নানা ব্যস্থতা,নবান্নের আয়োজনে চলে দিনরাত কর্মযজ্ঞ। নতুন চালের মিহিন মিষ্টি গন্ধে আমোদিত হয়ে ওঠে চারদিক।
হেমন্তে প্রকৃতির পরিবর্তনের সাথে সাথে কবি সাহিত্যিকের অনুভূতিতেও পরিবর্তন ঘটে,হেমন্তকে নিয়ে লিখেছেন নানা কবিতা,গল্প গান সমৃদ্ধ হচ্ছে সাহিত্য ভাণ্ডার।
" চারদিকে মউ মউ নবান্নের ঘ্রাণ--
কার্তিকের সোনা ধানে ভরে যায় গোলা,
হেমন্তের দিনগুলো আসে ঝকঝকে
সোনার থালায়--"
ঋতুবৈচিত্র্যে আমাদের এই দেশে অন্যান্য ঋতুকে নিয়ে কবি সাহিত্যিকগণ যেভাবে তাঁদের লেখায় মনোনিবেশ করেছেন, হেমন্তকে নিয়ে তেমনটি লিখেন নি। অনেকের কাছে হেমন্ত অবহেলিতই থেকেছে।প্রাচীন যুগে বৌদ্ধ সহজিয়াগণ রচিত চর্যাপদে হেমন্তের উল্লেখ না থাকলেও মধ্যযুগ (১২০১-১৮০০) এবং আধুনিকযুগে দুই বাংলার অনেক সুনামধন্য কবির কাব্যে হেমন্ত পেয়েছে তার আসল রূপ ও ঐতিহ্য তা অনস্বীকার্য। মহাকবি আলাওল তার ‘পদ্মাবতী’ কাব্যে ‘ষটঋতু বর্ণন’ খণ্ডে হেমন্তের অংকন করেছেন এভাবে--
“ঋতুস্থিত কহি ত্রার শুন দিয়া মন
কোন মত ছয় ঋতু কেমত লক্ষণ।
উত্তরেত হেমন্ত ঋতু ধবল আকার
লাল বস্ত্র পরিধান হিংগুলের ভার।।”
মধ্যযুগের কবি মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর 'কালকেতু' উপাখ্যানে হেমন্তের কিছুটা দৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। কবির ভাষায় -
"কার্তিক মাসেতে হয় হিমের প্রকাশ
যগজনে করে শীত নিবারণ বাস।"
বৈষ্ণব পদাবলীতে কৃষকের ঘরে ঘরে অঘ্রাণের নতুন ধানে সুখের আবেশ ছড়ায়। এ সময় কৃষাণ কৃষাণী পরম আনন্দে দিনাতিপাত করে।বৈষ্ণব পদকর্তা লোচন দাসের পদে লিখেন--
" অঘ্রাণে নোতুন ধান্য বিলাস
সর্বসুখ ঘরে প্রভু কি কাজ সন্ন্যাসে॥
পাটনেত ফোটে ফোটে শয়ন কম্বলে
সুখে নিদ্রা যাও তুমি আমি পদতলে॥"
কবি ঈশ্বরগুপ্ত হেমন্তের বর্ণনা করতে যেয়ে ভীষণ বীরত্বের কথা উল্লেখ করেছেন। অশ্বপৃষ্ঠে হেমন্ত ঋতু,যার আবাস হিমালয়ে।এমনটাই ধারণা করেছেন তিনি।কবির ভাষায়--
“হিম ঋতু মহীপতি হিমালয়ে নিবসিত
সংপতি ছাড়িয়া রাজমনী।
শাসন করিতে রাজা আসিতেছে অনিবার্য
তার সঙ্গে সেনানী হিমানী ॥”
প্রাচীনযুগের কবিদের লেখায় বাংলার ঋতুবৈচিত্র্য অলক্ষ্য থাকলেও আধুনিকযুগের কবি সাহিত্যিকের লেখায় হেমন্ত পেয়েছে পূর্ণতা। বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ তাঁর একটি বিখ্যাত গান ‘হিমের রাতে’ বলেছেন-- “হিমের রাতে ওই গগনের দীপগুলিরে,/হেমন্তিকা করল গোপন আঁচল ঘিরে।/ঘরে ঘরে ডাক পাঠালো /দীপালিকায় জ্বালাও আলো,/জ্বালাও আলো, আপন আলো, সাজাও আলোয় ধরিত্রীরে।”
বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম ‘অঘ্রাণের সওগাত’ কবিতায় কেবল হেমন্তের প্রকৃতির ছবিই আঁকেন নি, একই সঙ্গে পারিবারিক সংস্কৃতি, সম্প্রীতির চিত্র ও তুলে ধরেছেন।নজরুল বলেন-“ঋতুর খাঞ্জা ভরিয়া এলো কি ধরণীর সওগাত?/নবীন ধানের অঘ্রাণে আজি অঘ্রাণ হলো মাৎ।/‘বিন্নি পলাশ’ চালের ফিরনি/তশতরি ভরে নবীনা গিন্নি/হাসিতে হাসিতে দিতেছে স্বামীরে, খুশিতে কাঁপিছে হাত।/শিরনি রাঁধেন বড় বিবি, বাড়ি গন্ধে তেলেসমাত।/মিঞা ও বিবিতে বড় ভাব আজি খামারে ধরে না ধান/বিছানা করিতে ছোট বিবি রাতে চাপা সুরে গাহে গান;/শাশবিবি কন, আহা, আসে নাই/কতদিন হলো মেজলা জামাই।’’
হেমন্তের কথা আসলে প্রথমেই যাঁর নাম মানসপটে ভেসে ওঠে তিনি হলেন- প্রকৃতির কবি,নৈসর্গিক কবি, রূপসীবাংলার কবি জীবনানন্দ দাশ।কথাশিল্পী আবিদ আনোয়ারের ভাষায়-- "বাংলা কবিতার প্রেক্ষাপটে রবীন্দ্রনাথের রচনায় প্রাধান্য পেয়েছে বর্ষা ও শরৎ, কাজী নজরুল ইসলামের রচনায় গ্রীষ্ম আর জীবনানন্দের রচনায় হেমন্ত ও শীত। ‘তাঁকে হেমন্তের কবি’ অভিধায় অভিষিক্ত করলেও অত্যুক্তি হবে না।"
তাঁর হেমন্তের অসংখ্য কবিতা থেকে একটি এখানে তুলে ধরছি --
"চারিদিকে নুয়ে প’ড়ে ফলেছে ফসল/তাদের স্তনের থেকে ফোঁটা-ফোঁটা/ পড়িতেছে শিশিরের জল!/প্রচুর শস্যের গন্ধ বুকে তার থেকে আসিতেছে ভেসে/পেঁচা আর ইঁদুরের ঘ্রাণে ভরা/ আমাদের ভাঁড়ারের দেশ’; ‘হেমন্তের রৌদ্রের মতন/ফসলের স্তন/আঙুলে নিঙাড়ি/ এই ক্ষেতে ছাড়ি/অন্য ক্ষেতে চলিব কি ভেসে/এ-সবুজ দেশে/আরো একবার"
পল্লীকবি জসিমউদদীন ‘সুখের বাসর’ কবিতায় লিখেছেন-
“আশ্বিন গেল কার্তিক মাসে পাকিল ক্ষেতের ধান,/সারা মাঠভরি গাহিছে কে যেন হলদি কোটার গান।/ধানে ধানে লাগি বাজিছে বাজনা, গন্ধ উড়ায়ে বায়ু/কলমি লতার দোলন লেগেছে ফুরাল ফুলের আয়ু।”/
কবি আল মাহমুদের 'অঘ্রাণ' কবিতায় হেমন্ত এসেছে মানুষের প্রেমে,কামে, প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যে। কবির কবিতায়--
"আজ এই হেমন্তের জলদ বাতাসে/ আমার হৃদয় মন মানুষীর গন্ধে ভরে গেছে/রমণীর প্রেম আর লবণ সৌরভে/আমার অহংবোধ ব্যর্থ আত্মতুষ্টির ওপর/বসায়, মর্চের দাগ, লাল কালো, কট ও কষায়।"
নাগরিক কবি শামসুর রাহমান তাঁর ‘হেমন্ত সন্ধ্যায় কিছুকাল’ কবিতায় বলেন--“হেমন্তের হরিদ্রাভ পিঠের ক্ষতটি বলে, /‘কবি, আমাকে করাও স্নান,/ করো নিরাময়’/যে আমাকে ভালোবাসে তাকে কাঁদিয়ে/বারবার পড়িয়ে নিজের চোখ অশ্রুহীন আমি;/কীভাবে সারাবো ক্ষত? কী করে ঝরাবো/অব্যর্থ শিশির আর্ত হেমন্তের পীড়িত শরীরে?”
এ ছাড়াও বেগম সুফিয়া কামাল,সুকান্ত ভট্টাচার্য ,নির্মলেন্দু গুণ সহ অসংখ্য কবির কবিতায়, গানে ঋতুকন্যা হেমন্তের রূপবৈচিত্র্য রূপায়িত হয়েছে, যা এই পরিসরে আলোচনা করা সম্ভব হচ্ছে না।
হেমন্তকালে শিশির ঝরা নিশিতে ফোটে রজনীগন্ধা, গন্ধরাজ,মল্লিকা প্রভৃতি ফুলের দল।বিল-ঝিল,দীঘির কাচের মতো সুস্থির পানিতে ফোটে পদ্ম ও শাপলা ফুল।ভোরবেলা দুর্বাঘাসের ডগাগুলোতে শিশির কণারা কুসুম রোদের চুমুতে ঝিলিক হেসে শিহরণ জাগিয়ে তুলে কবির হৃদয়ে।কবি প্রকৃতির প্রেমে বিভোর হয়ে উচ্চারণ করেন--
‘আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে-এই বাংলায়/হয়তো মানুষ নয় হয়তো বা শঙ্খচিল শালিকের বেশে/ হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে/কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন আসিব এ কাঁঠাল-ছায়ায়;’