পদ্মা, আড়িয়াল খা, কুমার ও মধুমতিসহ কয়েকটি নদী বেস্টিত জেলার নাম ফরিদপুর। বিশেষ করে পদ্মা ও আড়িয়াল খা নদীর বিভিন্ন চরাঞ্চলের অধিকাংশ গ্রাম ছিলো উন্নয়ন বঞ্চিত। ছিলোনা শিক্ষার আলো, এমনকি চিকিৎসা পাওয়াটাও যেনো সোনার হরিম মনে করতো এসব চরাঞ্চলে বসবাসকারী হাজারো খেটে খাওয়া মানুষেরা।
পদ্মার চরের এমনি একটি সুবিধা বঞ্চিত এলাকার নাম গোলাপবাগ। ফরিদপুরের চরাঞ্চলের একটি একসময়ের অবহেলিত গ্রামাঞ্চল চরমাধবদিয়া ইউনিয়নের অন্তর্ভকাত গোলাপবাগ। বছরের দীর্ঘ সময় ধরে পানিবদ্ধ থাকা গোলাপবাগের একটা সময়ে রাস্তাঘাট, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কিছুই ছিলো না। শতকরা ৯৫ ভাগ পরিবারই ছিলো হতদরিদ্র। গত তিন দশকের ব্যবধানে এসব চিত্র এখন ঠাই নিয়েছে স্মৃতির খাতায়। যার নেপথ্যে রয়েছে হাজী লতিফুন্নেসা ফাউন্ডেশন নামে একটি মানবসেবী সংগঠন।
স্থানীরা জানান, পদ্মার চরবেষ্টিত গোলাপবাগ কোন একক গ্রাম নয়। চরমাধবদিয়া ইউনিয়নের একাধিক গ্রাম নিয়ে সেখানে এই গোলাপবাগের যাত্রা শুরু আশির দশকে। এই এলাকার মরহুম আব্দুল লতিফ খানের পুত্র মোঃ আব্দুর রশীদ খান হারুন ও আক্তারুজ্জামান খান। দরিদ্রপীড়িত এলাকায় এই পরিবারটির অর্থনৈতিকভাবে যথেষ্ট অগ্রসর এবং পূর্বপুরুষেরা গ্রামের মাতুব্বর শ্রেণির সুবাদে পড়াশুনার জন্য ছোটবেলাতেই এলাকা ছেড়ে ঢাকা যান আক্তারুজ্জামান খান। মেট্রিক পাশ করার আগেই তার ব্যবসার হাতেখড়ি। আর প্রথম জীবনের উপার্জিত টাকা দিয়ে ১৯৮২ সাল থেকেই শুরু করেন সমাজ সংস্কারের কাজ।
চরমাধবদিয়ার পাঁচ নম্বর ওয়ার্ডের আটটি গ্রাম নিয়ে গড়ে তুলেন এই গোলাপবাগ। এরপর গ্রামে গোলাপবাগ বেসরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন ও গ্রামের জরাজীর্ণ মসজিদটিকে সংস্কার করে সেখানে লিল্লাহ বোর্ডিং স্থাপনের মাধ্যমে শুরু করেন পথচলা।
সেই থেকে শুরু। এরপর যেমন নিজে পিছিয়ে থাকেননি। তেমনি গোলাপবাগের উন্নয়নের গতিকেও বাড়িয়ে নিয়ে এসেছেন উন্নয়নের মুল ধারায়। নিজের মায়ের নামে গড়ে তোলা গোলাপবাগ হাজী লতিফুন্নেসা ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে এরপর সেখানে স্থাপন করা হয়েছে এলাকাবাসীর জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে সেখানে গড়ে তুলেছেন হাফেজিয়া মাদ্রাসা মসজিদ ও এতিমখানা, গোলাপবাগ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, বেসরকারী চিকিৎসা কেন্দ্র, বয়স্ক নারী ও পুরুষদের শিক্ষা কেন্দ্র। শহরের টেপাখোলায় একটি কলেজ স্থাপন করা হয়েছে এই হাজী লতিফুন্নেসা ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে।
এসব প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় ব্যয় ভার বহনের জন্য নিজেদের সম্পদ থেকে প্রতিমাসে কয়েক লাখ টাকা সরবরাহ করেন তারা। এছাড়া তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে তারা এলাকার অনেক কর্মহীন বেকারদের কাজের সংস্থান করে সেসকল পরিবারের দারিদ্রতা মোচন করেছেন। নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে এই দুই ভাই আমেরিকায় চলে যান। সেখান থেকেও দেশের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে এসব জনহিতকর কাজ পরিচালনা করছেন। মাঝেমধ্যেই দেশে এসে তারা মানুষের সাহায্যার্থে এগিয়ে আসেন। তাদের এই মহতি উদ্যোগের ফলেই মূলত: একসময়ের এই দারিদ্রপীড়িত এলাকার মানুষ শিক্ষাবিস্তার ও কর্মের সংস্থানসহ নানাভাবে উপকৃত হচ্ছেন।
গোলাপবাগ জামে মসজিদ সংস্কার করে বহুতলবিশিষ্ট ভবন নির্মাণ করে দিয়েছে হাজী লতিফুন্নেসা ফাউন্ডেশন। সেখানে এতিমখানা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। মসজিদটির সংস্কারে সিংহভাগ অর্থ ব্যয় করেছেন হারুন খান। রয়েছে সামর্থ্য অনুযায়ী গ্রামের সবমানুষের সহায়তাও। মসজিদে এখন নয়নাভিরাম সুদৃশ্য মিনার তৈরির কাজ চলছে। যা মসজিদটিকে আলাদা সৌন্দর্য দিয়েছে। এই মসজিদের পাশের একটি কক্ষে দেখা গেলো শিশুরা হেফজ পাঠ নিচ্ছে।
পাঠদানরত ক্বারি রেজাউল করিম জানালেন, সেখানে ৪০ জনের মতো আবাসিক ছাত্র রয়েছে যারা হেফজ সম্পন্ন করছেন। আবাসিক ছাত্রদের থাকা ও খাওয়া সম্পূর্ণ ফ্রি সেই শুরু থেকেই। এলাকায় দ্বীনি শিক্ষা বিস্তারে প্রতিষ্ঠানটি ভুমিকা রাখছে। চরাঞ্চলের দারিদ্র পীড়িত পরিবারের সন্তানদের জন্য প্রতিষ্ঠানটি একটি আশীর্বাদ স্বরুপ মাথা তুলে দাড়িয়ে রয়েছে। এছাড়া সাধারণ শিক্ষাবিস্তারের জন্য রয়েছে লতিফুন্নেসা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ও গোলাপবাগ লতিফুন্নেসা প্রাথমিক বিদ্যালয়। বেসরকারি এই প্রাথমিক স্কুলটি সরকারিকরণ করা হয়েছে। সেখানে সরকারি খরচে দ্বীতল একটি ভবনও নির্মাণ করা হয়েছে।
গোলাপবাগ হাফেজিয়া মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল হাফেজ মাওলানা মোঃ রফিকুল ইসলাম জানান, গোলাপবাগ হাজী লতিফুন্নেসা ফাউন্ডেশনের সভাপতি মোঃ আব্দুর রশীদ খান হারুন। তারই ছোট ভাই হচ্ছেন আক্তারুজ্জামান খান। তারা দুই ভাই-ই আমেরিকা প্রবাসী। এই দুই মহৎ সমাজসেবক প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালনার জন্য তাদের বেশকিছু সম্পদ হতে উপার্জিত আয় নিয়মিতভাবে প্রদান করেন।
ঢাকার বসুন্ধরায় সাত তলা একটি ভবন হতে পাওয়া প্রতিমাসের আয় এবং গ্রামের ৩০ বিঘা জমির ফসলের যাবতীয় আয় ছাড়াও তারা আরো বিভিন্নভাবে অর্থ সহায়তা করে যাচ্ছেন এসব প্রতিষ্ঠান পরিচালনার জন্য। গ্রামের দাতব্য চিকিৎসা কেন্দ্রটিতে আমেরিকা হতে আনা ওষুধ তারা বিনামূল্যে রোগীদের জন্য বিতরণ করেন। এসব কাজের সম্পূর্ণ দ্বায়িত্ব বহন করেন আব্দুর রশীদ খান হারুন সাহেব ও আক্তারুজ্জামান খান সাহেব।
এব্যাপারে চরমাধবদিয়া ইউনিয়নের ৫ নং ওয়ার্ড মেম্বার আব্দুল হক বলেন, এই প্রতিষ্ঠানগুলোর কারণে তাদের এলাকার মানুষ অনেক উপকৃত হয়েছে। কারণ এখানকার বেশিরভাগ মানুষই হতদরিদ্র। রাস্তাঘাট, স্কুল, কলেজ কিছুই ছিলোনা। এখন সেই অবস্থা নেই। নিজেদের অর্থায়নে এসকল মাদ্রাসা, স্কুল, এতিমখানা, মসজিদ, বালিকা বিদ্যালয়, স্বাস্থ্যকেন্দ্র পরিচালনা করেন তারা। গ্রামের মানুষ বিনামূল্যে এসব সেবা পায়। এছাড়া তারা সবসময়েই সাধারণ মানুষের সাহায্য-সহযোগীতায় এগিয়ে আসেন। এই কোভিড-১৯ এর সময়ে তারা বিপন্ন মানুষকে নানাভাবে সাহায্য সহযোগিতা করেছেন।
এদিকে গোলাপবাগের অগ্রযাত্রা থামিয়ে দিতে ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে বলে দাবী স্থানীয়দের। তারা জানান, একটি চক্র এ অগ্রযাত্রাকে ব্যহত করতে এরই মধ্যে অপপ্রচারে নেমেছে। সম্প্রতি গোলাপবাগ মসজিদে এক ওয়াক্ত নামাজে ইমাম নাথাকায় ওই চক্রটি ফেসবুক লাইভে এসে অপপ্রচার চালায়। এ প্রসঙ্গে মসজিদ কর্তৃপক্ষ দাবী করেন, গোলাপবাগ হাফেজিয়া মাদ্রাসায় চারজন শিক্ষক রয়েছেন। এদের মধ্যে একজন সম্প্রতি অন্যত্র যোগ দেন।
কয়েকদিন আগে মাদ্রাসার অন্য তিন জনের মধ্যে একজন ছুটিতে এবং আরেকজন অসুস্থ ছিলেন। মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল মাদ্রাসার কাজে বাইরে ছিলেন। যার এশার নামাজে ইমামতি করার দ্বায়িত্ব ছিলো তিনি প্রচন্ড অসুস্থ থাকায় ওই ওয়াক্তে তিনি ইমামতি করতে পারেন নি। ওই ওয়াক্তে মাদ্রাসার ছাত্ররা নামাজ পড়াতে গেলে আপত্তি তোলে চক্রটি। এতে জামাত দাড়াতে দেরি হওয়ায় সেখানে মসজিদে দাড়িয়েই ফেসবুকে লাইভ শুরু করেন ওই গ্রামের এক যুবক। সে মসজিদে একজন ইমাম না থাকায় নামাজ পড়তে তাদের সমস্যার কথা উল্লেখ করে মসজিদের কমিটির সাথে কোনোরুপ আলোচনা না করেই একজন ইমাম নিযুক্তির কথা বলে। এতে বিভ্রান্তিতে পড়ে সাধারণ মুসল্লিরা।
গোলাপবাগের বাসিন্দা ও সৌদি প্রবাসী যুবক মীর্জা প্রিন্স আলী বলেন, ফেসবুকে লাইভ করে প্রকারান্তরে এই মসজিদের সংস্কারে বিপুল অর্থ ব্যয় করা আব্দুর রশীদ খান হারুন সাহেব এবং তার ভাই আক্তারুজ্জামান খান সাহেবের এই মহত উদ্যোগকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে। তাদের অপমানিত করা হয়েছে। এটি লাইভে না বলে সে মসজিদ কমিটি বা গ্রামের মুরুব্বীদের জানাতে পারতো। সেটি না করে তারা অন্যায়-অপরাধ ও ভুল করেছে। বিষয়টি নিয়ে ফেসবুকে পরিকল্পিতভাবে অপপ্রচার চালানোর অভিযোগ করেন তারা। যার ফলে একটি বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির আশঙ্কাও প্রকাশ করেন তারা।
স্থানীয়দের দাবী, এরই মধ্যে গোলাপবাগে মাদকের হানা পড়েছে, কিছু কিছু মানুষ মাদক সেবন ও বিক্রির সাথে যুক্ত হয়ে পড়েছে। যাদের কেউ কেউ ওই চক্রের সাথে মিশে এসব অপপ্রচার চালাচ্ছে, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিই তাদের উদ্ধেশ্য।
এদিকে স্থানীয়দের কেউ কেউ জনৈক আমেরিকার প্রবাসীর ইন্দনে এ অপপ্রচার চালানো হচ্ছে বলে দাবী করলেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে লাইভ করা যুবক তৌহিদুল ইসলাম আলমগীর জানান, কোনো কিছু ভেবে তিনি লাইভ করেননি। মসজিদের বর্তমান কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি অবহিত করতেই তিনি এটি করেছেন। তবে, কারো ইন্ধনে কোনো কিছু করার বিষয়টি তিনি অস্বিকার করেন।
যদিও ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা মো. আকতারুজ্জামান খান বলেন, কোনো ধরণের অপপ্রচারে গোলাপবাগের অগ্রযাত্রাকে থামাতে পারবেনা।