অস্ত্র, মাদক ও অর্থপাচার মামলার পর তিনি অবৈধ সম্পদ অর্জনের মামলায় বুধবার জামিন হয়েছে। তার আইনজীবী মাহবুবুল আলম সাংবাদিকদের বলেছেন, সম্রাটের বিরুদ্ধে মোট চারটি মামলা ছিল। সবগুলো মামলায় জামিন হওয়ায় তার কারাগার থেকে মুক্তি পেতে আর বাধা নেই।
কারাগারের নিয়ম অনুযায়ী, জামিনের আদেশে কারাগারে পৌঁছানোর পর মুক্তি দেয়া হয়। সেই হিসাবে তাকে নতুন কোন মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো না হলে আজ (বুধবার) বিকেল বা বৃহস্পতিবার নাগাদ তিনি মুক্তি পেতে পারেন। জামিনযোগ্য মামলা হওয়া সত্বেও ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাটকে আড়াই বছরের বেশি কারাগারে থাকতে হল বিচার শেষ হবার আগেই।
কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের একটি গ্রাম থেকে ২০১৯ সালের ছয়ই অক্টোবর ইসমাইল হোসেন সম্রাটকে গ্রেপ্তার করে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়ন (র্যাব)। সেই সময় তার আরেকজন সহযোগী এনামুল হক আরমানকেও গ্রেপ্তার করা হয়।এরপর থেকেই তিনি কারাগারে রয়েছেন।
অবৈধ সম্পদ, অস্ত্র বা মাদকের মামলা থাকলেও যুবলীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের এই সাবেক নেতা আলোচিত হয়েছিলেন ঢাকায় ক্যাসিনো ব্যবসায় সংশ্লিষ্টতার কারণে।
যুবলীগ ঢাকা দক্ষিণের সভাপতি হিসাবে বহুদিন ধরে ক্ষমতায় থাকলেও তাকে নিয়ে আলোচনা শুরু হয় আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার একটি মন্তব্যের পর।
দুই হাজার উনিশ সালের ১৪ই সেপ্টেম্বর আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সভায় যুবলীগের কয়েকজন নেতার প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, তারা শোভন-রাব্বানীর চেয়েও খারাপ।
সেই সময় ইসমাইল হোসেন চৌধুরীর দিকে ইঙ্গিত করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, যুবলীগের ঢাকা মহানগরের একজন নেতা যা ইচ্ছে করে বেড়াচ্ছে, চাঁদাবাজি করছে।
''আরেকজন এখন দিনের বেলায় প্রকাশ্যে অস্ত্র উঁচিয়ে চলেন সদলবলে অস্ত্র নিয়ে ঘোরেন। এসব বন্ধ করতে হবে। যারা অস্ত্রবাজি করেন, যারা ক্যাডার পোষেণ, তারা সাবধান হয়ে যান। তা না হলে যেভাবে জঙ্গি দমন করা হয়েছে, একইভাবে তাদেরও দমন করা হবে।''
তার ওই মন্তব্যের পরই একপ্রকার শুদ্ধি অভিযান শুরু করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সেই সময় ওই অভিযান 'ক্যাসিনো অভিযান' নামে বিশেষ পরিচিত পেয়েছিল। আঠারোই সেপ্টেম্বর ২০১৯ সালে ঢাকায় চারটি ক্লাবে অভিযান চালিয়ে বন্ধ করে দেয় র্যাব। সেসব ক্যাসিনোতে অবৈধভাবে জুয়া খেলা হতো।
অবৈধভাবে একটি ক্যাসিনো পরিচালনা করার অভিযোগে যুবলীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াকে র্যাব গ্রেফতার করে।
এরপর এই সংগঠনেরই আরেকজন নেতা গোলাম কিবরিয়া শামীম বা জি কে শামীমের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও বাড়িতে অভিযান চালিয়ে তাকে তার সাতজন দেহরক্ষীসহ আটক করে। তার বাড়ি থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ, এফডিআর জব্দ করা হয়।
আওয়ামী লীগের নেতারা ওই অভিযানকে দলে 'শুদ্ধি অভিযান' বলে বর্ণনা করেছিলেন। সেই সময় আওয়ামী লীগের নেতারা বলেছিলেন, তারা যুবলীগসহ সহযোগী সংগঠনগুলো ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নিয়েছে।
এসব গ্রেপ্তারের পরেই যুবলীগ ঢাকা দক্ষিণের তৎকালীন সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরীকে গ্রেপ্তার নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। কারণ ওই দুই নেতাই জিজ্ঞাসাবাদে তাদের অপকর্মের প্রধান পৃষ্ঠপোষক হিসাবে ইসমাইল হোসেন চৌধুরীর নাম বলেছিলেন।
অভিযোগ ছিল, ক্যাসিনোর এসব ক্লাব নিয়ন্ত্রণ করতেন ইসমাইল হোসেন চৌধুরী। এছাড়া মতিঝিল এলাকায় চাঁদাবাজির অভিযোগও ছিল। অবৈধ ক্যাসিনোসহ নানা দুর্নীতির বিরুদ্ধে চলা অভিযান চলছে এবং এই পুরো সময়টা ধরেই আলোচনার শীর্ষে ছিলেন এই যুবলীগ নেতা।
তখন গণমাধ্যমগুলোতে প্রায় প্রতিদিনই সম্রাটের অবস্থান এবং কর্মকাণ্ড নিয়ে নানা ধরণের প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছে।
ক্যাসিনো বিরোধী অভিযানের শুরুর দিকে যুবলীগ নেতা ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট ঢাকার কাকরাইল এলাকায় তার ব্যক্তিগত কার্যালয়ে অবস্থান নিয়েছিলেন কয়েকশ' সমর্থকের পাহারায়।
সেই অবস্থানের মাধ্যমে তার পক্ষ থেকে অভিযানের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক শক্তি দেখিয়ে একটা জানান দেয়ার চেষ্টা ছিল বলে যুবলীগেরই অনেকে মনে করেন।
কিন্তু তিন দিন পর তার সমর্থকরা লাপাত্তা হয়ে যান। তখন থেকে সেই যুবলীগ নেতারও খোঁজ মিলছিল না।
তাকে ঘিরে জন্ম নিতে থাকে নানা আলোচনা। আওয়ামী লীগ বা সরকারের প্রভাবশালী কারও সাথে তার সম্পর্ক আছে কিনা, তাকে গ্রেফতার করা যাবে কিনা - এমন অনেক প্রশ্ন ওঠে। এরসাথে এমন জল্পনাও ছিল যে, তাকে ধরে রাখা হতে পারে, সময় বুঝে র্যাব ঘোষণা দিতে পারে।
তবে সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে ছয়ই অক্টোবর কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। তাকে সেখান থেকে ঢাকার কাকরাইলে নিজের কার্যালয়ে নিয়ে আসা হয়।
সেই কার্যালয়ে অভিযান চালানোর পর অবৈধ অস্ত্র, মাদক এবং ক্যাঙ্গারুর চামড়া উদ্ধার করা হয়। অবৈধভাবে বন্যপ্রাণী রাখার অভিযোগেই এখন তার ছয় মাসের কারাদণ্ড দেয় র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত।
সেই বছরের ২৩শে নভেম্বর যুবলীগের সম্মেলনে নতুন কমিটি গঠন করা হয়। এরপর সংগঠনটির ঢাকা মহানগরসহ স্থানীয় কমিটিগুলোও ভেঙ্গে দিয়ে নতুন কমিটি গঠন করা হয়।
গ্রেপ্তারের সময় ইসমাইল হোসেন সম্রাট ছিলেন ঢাকা মহানগর যুবলীগ (দক্ষিণ) সভাপতি। তার উত্থান হয়েছিল মতিঝিল রমনা এলাকায় পিকেটিংয়ের মাধ্যমে।
জেনারেল এরশাদের আমলে রাজনীতিতে সরাসরি সম্পৃক্ত না থাকলেও বিরোধী দলগুলোর আন্দোলনে মতিঝিল এলাকায় পিকেটিংয়ে নামতেন ইসমাইল হোসেন সম্রাট।
আশির দশকের শেষদিকে যুবলীগের কয়েকজন নেতার মাধ্যমে যুবলীগে সম্পৃক্ত হন। সেই সময় তিনি যুবলীগের সাধারণ একজন ওয়ার্ড নেতা ছিলেন। উনিশশো তিরানব্বই সালে ঢাকার ৫৩ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের যুগ্ম সম্পাদকের দায়িত্ব পেয়েছিলেন। সে সময় যুবলীগের চেয়ারম্যান ছিলেন আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতা শেখ ফজলুল করিম সেলিম।
দুই হাজার তিন সালে ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হন। ওমর ফারুক চৌধুরী যুবলীগের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পান ২০১২ সালে।এরপর ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট যুবলীগের ঢাকা দক্ষিণের সভাপতি হন।
কাকরাইলে তার কার্যালয়ে অভিযান চালিয়ে একটি বিদেশি পিস্তল, ১১৬০টি ইয়াবা, ১৯ বোতল বিদেশি মদ, দুটি ক্যাঙ্গারুর চামড়া এবং নির্যাতন করার বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম পাওয়ার কথা জানানো হয়েছিল র্যাবের পক্ষ থেকে।
ক্যাঙ্গারুর চামড়া পাওয়ায় ইসমাইল হোসেন চৌধুরীকে ছয়মাসের কারাদাণ্ড দেয় র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। এছাড়া ঢাকার রমনা থানায় মাদক নিয়ন্ত্রণ ও অস্ত্র আইনে দুটি মামলা করা হয়্। এরপর দুর্নীতি দমন কমিশন ১২ই নভেম্বর তার বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের মামলা করে।
সেখানে অভিযোগ করা হয়, ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্প্রাট অবৈধভাবে দুই কোটি ৯৪ লাখ ৮০ হাজার ৮৭ টাকার অবৈধ সম্পদের মালিক হয়েছেন।
দুদকের অভিযোগ, অবৈধ ব্যবসা ও অবৈধ কার্যক্রমের মাধ্যমে তিনি এসব আয় করেছেন। মতিঝিল ও ফকিরাপুল এলাকার ১৭টি ক্লাব নিয়ন্ত্রণ করতেন এবং মোটা অঙ্কের কমিশন নিতেন। এছাড়া নামে বেনামে বিভিন্ন এলাকায় একাধিক ফ্ল্যাট, প্লট ও বাড়ি কিনেছেন।
এসব মামলায় কয়েক দফায় ইসমাইল হোসেন চৌধুরীর জামিন চাওয়া হয়। কিন্তু তাতে আপত্তি জানায় রাষ্ট্রপক্ষ। ফলে তার জামিন হয়নি। করোনা ভাইরাসের প্রভাবে আদালতের কার্যক্রম কিছুদিন স্থগিত থাকায় মামলার তদন্ত ও বিচার কার্যক্রমও ব্যাহত হয়।
তবে প্রায় দুই বছর পর চারটি মামলার মধ্যে অস্ত্র ও অর্থ পাচারের দুই মামলায় ১০ই এপ্রিল জামিন হয়। পরদিন মাদক মামলায় তাকে জামিন দেয় আদালত।
সর্বশেষ অবৈধ সম্পদ অর্জনের মামলায় বুধবার তাকে জামিন দেয়া হয়েছে।
-BBC বাংলা থেকে সংগৃহীত।
সম্পাদক ও প্রকাশকঃ মোঃ মুরসিদ আহমেদ সিকদার, মোবাইল : 01728 311111
ঢাকা অফিসঃ হোল্ডিং-১৩, লাইন-৬, রোড- ১২, ব্লক-বি, মিরপুর-১১, ঢাকা-১২১৬
ফরিদপুর অফিসঃ মুজিব সড়ক, ফরিদপুর, ই-মেইলঃ [email protected]
Copyright © August, 2020-2025 @ Daily Somoyer Protyasha