ইসমাইল হোসেন বাবু,বাগেরহাট থেকে ফিরে এসেঃ
ভারতীয় উপমহাদেশের অনন্য স্থাপত্যশৈলীর নিদর্শন- মুসলিম স্মৃতিস্তম্ভ গুলোর মধ্যে অন্যতম সুলতানি আমলের ‘ষাটগম্বুজ’ মসজিদ। যার অবস্থান বাগেরহাট জেলা থেকে সাত কিলোমিটার পশ্চিমে খুলনা -বাগেরহাট মহাসড়কের উত্তর পাশে সুন্দরঘোনা গ্রামে।
অনেক পুরাতন মসজিদ ষাটগম্বুজ। এটা শুধু বাংলাদেশই নয়, সারা বিশ্বে এক নামে পরিচিত। বাংলাদেশে অসংখ্য ঐতিহ্যবাহি মসজিদ রয়েছে। যার মধ্যে অন্যতম বাগেরহাটের ঐতিহাসিক ষাটগম্বুজ মসজিদ।
আকৃতির বিচারে বাংলাদেশের ভূখন্ডে অবস্থিত মধ্যযুগীয় মসজিদগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় ষাটগম্বুজ মসজিদ। এটি হযরত খান জাহান (রহ:) এর সর্ববৃহৎ কীর্তি/নিদর্শন। মসজিদটি উত্তর-দক্ষিণে বাইরের দিকে প্রায় ১৬০ ফুট ও ভিতরের দিকে প্রায় ১৪৩ ফুট লম্বা এবং পূর্ব-পশ্চিমে বাইরের দিকে প্রায় ১০৮ ফুট ও ভিতরের দিকে প্রায় ৯০ ফুট চওড়া। মসজিদ মুসলিম সমাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। মুসলমানদের বিভিন্ন ধর্মীয় কার্যাবলীর প্রাণকেন্দ্র। এখানে প্রার্থনা করা ছাড়াও শিক্ষা প্রদান, তথ্য বিতরণ এবং বিরোধ নিষ্পত্তি করা হয়।
দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত প্রাচীন এ মসজিদটিকে ১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্য ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ স্টেইজ হিসাবে মর্যাদা দেয়। মসজিদটি বাগেরহাট শহরকে বাংলাদেশের তিনটি বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী শহরের মধ্যে স্থান করে দিয়েছে।
এর অবস্থান দেশের দক্ষিণ- পশ্চিমের জেলার খুলনা থেকে প্রায় ৪৩কিলোমিটার ও বাগেরহাট শহর থেকে মাত্র ৭ কিলোকিটার দুরে খুলনা-বাগেরহাট মহাসড়কের উত্তর পাসে ষাটগুম্বজ বাসস্টপেজ এর কাছে সুন্দরঘোনা গ্রামে অবস্থিত ষাটগম্বুজ মসজিদটি। মসজিদের নাম অনুসারেই বাসস্টপেজের নামকরণটি করা হয়েছে।
এছাড়া ঢাকা থেকে খুলনাগামী আন্তঃনগর ট্রেন সুন্দরবন এক্সপ্রেসে খুলনা এসে সেখান থেকে বাসে মাইক্রো বা সিএনজিতে করে বাগেরহাট আসতে পারবেন।
ইতিহাস
মসজিদটির গায়ে কোনো শিলালিপি নেই। তাই এটি কে নির্মাণ করেছিলেন বা কোন সময়ে নির্মাণ করা হয়েছিলো সে সম্বন্ধে সঠিক কোনো তথ্য খুজে পাওয়া যায়নি। তবে মসজিদটির স্থাপত্যশৈলী দেখলে নিশ্চিত ভাবে ধারণা করা হয় এটি খান-ই-জাহানের নির্মিত। ধারণা করা হয় পঞ্চদশ শতাব্দীতে ‘খান-উল-আযম উলুঘ খান-ই-জাহান’ (খানজাহান আলী (রঃ) নামে বেশি পরিচিত) মসজিদটি নির্মাণ করেন।
মসজিদের পূর্বদিকে (১২৫মি. দুরে) কোদালধোয়া দিঘি, পশ্চিমে বিশাল আকারের ঘোড়াদিঘি উত্তরে (৩’শ মিটার দুরে) খানজাহানের বসত ভিটা বা ঢিবি এবং দক্ষিনে খুলনা-বাগেরহাট মহাসড়ক। খানজাহানের দরগাহ থেকে মসজিদটির দুরত্ব প্রায় আড়াই কিলোমিটার।
আকৃতির বিচারে বাংলাদেশের ভূখন্ডে অবস্থিত মধ্যযুগীয় মসজিদগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় ষাটগম্বুজ মসজিদ। এটি হযরত খান জাহান (রহ:) এর সর্ববৃহৎ কীর্তি/নিদর্শন।
নামকরণ ঐতিহাসিকরা মনে করেন, এই ষাটটি থামের অস্থিত্ব থেকেই মসজিদটির নাম হয় ‘ষাটখাম্বাজ’ সেখান থেকে কালের বিতর্তনে বিকৃত কথ্যরূপ ‘ষাটগম্বুজ’। আবার কোন কোন ঐতিহাসিক মনে করেন, সাতটি সারিবদ্ধ গম্বুজ সারি আছে বলে এ মসজিদের ‘সাত গম্বুজ’ এবং তা থেকে ‘ষাটগম্বুজ’ নাম হয়েছে। নাম করণ সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের আরেকটি মত হচ্ছে, মসজিদটির ছাদ সমান নয় গুম্বুজ আকৃতির। অর্থাৎ ছাদে গুম্বজ। যার থেকে মসজিদটি ‘ছাদ গুম্বুজ’ নামে পরিচিতি লাভ করেছিল। সেখান থেকে কথ্যরুপ ‘ষাটগুম্বুজ’ নাম হয়েছে।
মসজিদটি উত্তর-দক্ষিণে বাইরের দিকে প্রায় ১৬০ ফুট ও ভিতরের দিকে প্রায় ১৪৩ ফুট লম্বা এবং পূর্ব-পশ্চিমে বাইরের দিকে প্রায় ১০৮ ফুট ও ভিতরের দিকে প্রায় ৯০ ফুট চওড়া। দেয়ালগুলো প্রায় ৮থেকে ৫ফুট পুরু। মসজিদের ভেতরে মেঝে হতে ছাদের উচ্চতা প্রায় ২১ ফুট।
মসজিদটি ষাটগম্বুজ নামে পরিচিত হলেও এতে মোট গুম্বজ আছে ৮১টি। মসজিদের চার কোনের মিনার বা বুরুজের উপরের ৪টি গুম্বজ বাদ দিলে গম্বুজ সংখ্যা ৭৭টি। আর ৭৭টি গম্বুজের মধ্যে ৭০ টির উপরিভাগ গোলাকার এবং মধ্যের একটি সারিতে ৭টি গুম্বজ চারকোণবিশিষ্ট। দক্ষিণ-পূর্ব কোণের বুরুজটির ভিতর দিয়ে উপরে (ছাদে) উঠার সিঁড়ি আছে। এর নাম রওশনকোঠা। উত্তর-পূর্ব কোনের বুরুজটির নাম আন্ধারকোঠা। এটিতেও উপরে ওঠার সিঁড়ি ছিলো যা বর্তমানে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
ষাটগম্বুজ মসজিদের পূর্ব-পশ্চিমে লম্বালম্বি ভাগে ৭টি সারিতে বিভক্ত মোট ৭৭টি গুম্বজ আছে। গুম্বজগুলোর ছাদ-পরিকল্পনার এই ভার বহনের জন্য নিচের অংশে সারিবদ্ধভাবে ৬০টি পাথরের থাম বা পিলার আছে।
ঐতিহাসিকরা মনে করেন, এই ষাটটি থামের অস্থিত্ব থেকেই মসজিদটির নাম হয় ‘ষাটখাম্বাজ’ সেখান থেকে কালের বিতর্তনে বিকৃত কথ্যরূপ ‘ষাটগম্বুজ’। আবার কোন কোন ঐতিহাসিক মনে করেন, সাতটি সারিবদ্ধ গম্বুজ সারি আছে বলে এ মসজিদের ‘সাত গম্বুজ’ এবং তা থেকে ‘ষাটগম্বুজ’ নাম হয়েছে।
ভিতরে প্রবেশ করতে বিদেশী পর্যটক দের জন্য ৫০০ টাকা। দেশী পর্যটক দের জন্য ৩০ টাকা । মাধ্যমিক ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য ১০ টাকা প্রবেশ ফি দিয়ে আপনাকে ষাটগম্বুজ মসজিদের বাউন্ডারী এলাকার মধ্যে প্রবেশ করতে হবে। আমি প্রধান ফটকের কাছেই থাকলাম কিছুটা সময়। পাশেই দুটি স্মারক স্থম্ভ। এখানে বাঘেরহাট তথা ষাটগম্বুজ মসজিদ কোন ঘটনার স্মৃতি বহন করে চলেছে তা লিপিব্ধ রয়েছে।সেটা দেখলাম এবং জানলাম অজানা অনেক কিচ্ছুই ।
মসজিদের পাশের পায়ে হাঁটার রাস্তাটা দারুণ সুন্দর আর শুক্রবার বলে দেশের বিভিন্ন জেলার উপজেলা থেকে এসেছেন ঐতিহাসিক ‘ষাটগম্বুজ’ মসজিদ দেখতে। অস্বাভাবিক অনেক ভীড় ও নানাধরনের মানুষ ব্যস্ত। কোনো একটা জায়গা যে খালি পাব ছবি তোলার জন্য, তেমন পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছিল খুবই কম।
পূর্বের স্থম্ভ বা পিলার
জনশ্রুতি আছে যে, হযরত খানজাহান (রঃ) ষাটগুম্বুজ মসজিদ নির্মাণের জন্য সমুদয় পাথর সুদূর চটগ্রাম, মতামত্মরে ভারতের উড়িষ্যার রাজমহল থেকে তাঁর অলৌকিক ক্ষমতা বলে জলপথে ভাসিয়ে এনেছিলেন। ইমারতটির গঠন বৈচিত্রে তুঘলক স্থাপত্যের বিশেষ প্রভাব পরিলক্ষিত হয়।
মসজিদের ভিতরে পশ্চিম দেয়ালে ১০টি মিহরাব আছে। মাঝের মিহরাবটি আকারে বড় এবং তুলনা মূলক অধিক কারুকার্যমন্ডিত। এ মিহরাবের দক্ষিণে ৫টি ও উত্তরে ৪টি মিহরাব আছে। শুধু মাঝের মিহরাবের ঠিক পরের জায়াগাটিতে উত্তর পাশে একটি ছোট দরজা।
ধারণা করা হয়, খান-ই-জাহান এই মসজিদটিকে নামাযের কাজ ছাড়াও দরবার ঘর হিসেবে ব্যবহার করতেন, আর এই দরজাটি ছিলো দরবার ঘরের প্রবেশ পথ। আবার কেউ কেউ বলেন, মসজিদটি সেসময় মাদ্রাসা হিসেবেও ব্যবহৃত হত।
মসজিদটির পূর্ব দেয়ালে ১১টি বিরাট আকারের খিলানযুক্ত দরজা আছে। মাঝের দরজাটি অন্যগুলোর চেয়ে বড়। উত্তর ও দক্ষিণ দেয়ালে আছে ৭টি করে দরজা। পশ্চিম দিকের প্রধান মেহরাবের পাশে ১টি সহ ষাটগুম্বুজ মসজিদের মোট ২৬টি দরজা আছে। মসজিদের ৪ কোণে ৪টি মিনার বা বুরুজ আছে। এগুলোর নকশা গোলাকার এবং এরা উপরের দিকে সরু হয়ে গেছে। এদের কার্ণিশের কাছে বলয়াকার ব্যান্ড ও চূঁড়ায় গোলাকার গম্বুজ আছে। মিনারগুলোর উচ্চতা, ছাদের কার্নিশের চেয়ে বেশি।
সামনের দুটি মিনারে প্যাঁচানো সিঁড়ি ছিলো এবং এখান থেকে আযান দেবার ব্যবস্থা ছিলো। এদের নাম রওশনকোঠা ও আন্ধারকোঠা।
বাগেরহাটের ঐহিত্যবাহী ষাটগম্বুজ মসজিদের ইমাম (খতিব) আলহাজ মাওলানা মো. হেলাল উদ্দিননের সাথে কথা হয় তিনি জানান, প্রতিদিনই দেশি-বিদেশি পর্যটকরা আসেন এখানে। তবে ঈদের ছুটিতে ষাট গম্বুজ মসজিদ ও খান জাহান আলীর মাজার এলাকায় দর্শনার্থীদের ভিড় সবচেয়ে বেশি হয়। হাজারো দর্শকের পদচারণায় উৎসব মুখর পরিবেশ বিরাজ করে সেই সমায়।
তিনি সহ উপস্থিত বেশ কয়েকজন প্রবীন লোক আব্দুস ছালাম, মো.ওয়াজেদ আলী এবং এক দোকানদার জানালেন, ষাট গম্বুজ মসজিদ খোলা ও বন্ধের সময় রবিবারে পূর্ণ দিন কেল্লা বন্ধ থাকে এবং সোমবার খোলা হয় বেলা ২.০০ থেকে। গরমকালে কেল্লা খোলা থাকে সকাল ১০ টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত। শীতকালে কেল্লা খোলা হয় সকাল ৯টায় থেকে আর বিকেল ৫ টায় বন্ধ করা হয়। শীত ও গরমকাল উভয় সময়ই দুপুর ১টা থেকে ১.৩০ পর্যন্ত কেল্লা বন্ধ রাখা হয়। তবে শুক্রবারে জুম্মার নামাযের জন্যে ১২ টা ৩০ মিনিট থেকে থেকে ৩ টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত কেল্লা বন্ধ থাকে।
আরও অজানা তথ্য
সুলতান নসিরউদ্দীন মাহমুদ শাহের (১৪৩৫-৫৯) আমলে খান-উল-আযম উলুঘ খান-ই-জাহান (রঃ) সুন্দরবনের কোল ঘেঁষে খলিফাবাদ রাজ্য গড়ে তোলেন। খানজাহান তার প্রশাসনিক রাজধানীতে শাসনকার্য পরিচালনা এবং বৈঠক করার জন্য একটি দরবার হল গড়ে তোলেন, যা ষাট গম্বুজ মসজিদ নামে পরিচিত। এর পরিকল্পনার সাথে দিল্লি ও লাহোরের বাদশাহী মসজিদের মিল রয়েছে। মসজিদটিতে তুঘলকি ও জৌনপুরী নির্মাণশৈলী এতে সুস্পষ্ট।
কোথায় থাকবেন এখানে আসলে ,মানে বাগেরহাটে থাকার জন্য তেমন ভাল ব্যবস্থা এখন পযন্ত গডে উঠেনি, তবে ঘুরে দেখলাম মাঝারি মানের কিছু আবাসিক হোটেল আছে। রেল রোডে মমতাজ হোটেলে সুযোগ সুবিধা কম থাকলেও সেবার মান তুলনামূলক ভাল, তবে খরচ একটু বেশি। এছাড়া বাগেরহাট সদরে সরকারি গেস্টহাউস রয়েছে, হোটেল অভি ছাড়াও কেন্দ্রীয় বাস স্টেশন সংলগ্ন হোটেল আল আমিন এবং হোটেল মোহনা তে ৪০০ টাকা থেকে ১০০০ টাকায় রাত্রি যাপন করতে পারবেন। কিংবা,খুলনা থেকে বাগেরহাট বাসে যেতে মাত্র ১ ঘণ্টা সময় লাগে তাই রাত্রি যাপনের জন্য প্রয়োজনে চলে আসতে পারেন খুলনা বিভাগীয় শহরে।
খাবার সুবিধা
এখানে কিছু সাধারণ মানের খাবার হোটেল রয়েছে তাই খাওয়ার জন্য বাসস্ট্যান্ড কিংবা দরগার কাছে হোটেলগুলোতে যেতে পারেন। তবে অবশ্যই খাবারের মান ও দাম সম্পর্কে জেনে নিবেন।
রয়েছে একটি জাদুঘর
ষাটগম্বুজ মসজিদের পাশেই । ইউনেস্কোর সহযোগিতায় বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর এটি প্রতিষ্ঠা করেছে। ঐতিহাসিক এলাকাটি থেকে প্রাপ্ত প্রাচীন নিদর্শনগুলো এখানে সংরক্ষণ করা হয়েছে যাতে বাগেরহাটের ইতিহাস সম্পর্কে মানুষকে জানানো যায়।
দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত প্রাচীন এ মসজিদটিকে ১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্য ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ স্টেইজ’ হিসাবে মর্যাদা দেয়। মসজিদটি বাগেরহাট শহরকে বাংলাদেশের তিনটি বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী শহরের মধ্যে স্থান করে দিয়েছে।
প্রিন্ট

বালিয়াকান্দিতে মোবাইলকোট পরিচালনায় দুই ট্রলি চালককে জরিমানা 
ইসমাইল হােসেন বাবু, সিনিয়র ষ্টাফ রিপাের্টার 




















